অতুলপ্রসাদ সেন ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের গল্প / Atulprasad Sen Life Story on Forbidden Relationship

Atulprasad Sen Life Story on Forbidden Relationship (অতুলপ্রসাদ সেন ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের গল্প) is the essence of this article. It can be treated as the part of his biography (অতুলপ্রসাদ সেন জীবনী)


দেখুন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রসিকতা করে যাঁদেরকে বলেছেন ‘অ-সুর’ বা যাঁদেরকে বলেছেন 'সুরকালা', আমি তাদের দলেই পড়ি; কারণ গানের সুর সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণা নেই, তার অলিগলি সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। কিন্তু সবার মতই আমিও গান শুনি, গান শুনতে খুবই ভালোবাসি। সেজন্যই বোধহয়, অনেক সময় গানের চাইতে গায়ক বা গায়িকার জীবনের গল্প নিয়ে আমি কথা বলি, কথা বলতে আমার ভালো লাগে। আজও বলবো, এমনই এক গায়কের জীবনের গল্প, যে গল্প শুনলে সত্যিই মন খারাপ হয়ে যায়।

 যাঁর সম্পর্কে আজ কথা বলতে চাই, তাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায় একবার বলেছিলেন, মানুষের জীবনে গভীর দুঃখ, গভীর বেদনা ভালো, বেশ ভালো, যদি সেই দুঃখ বা বেদনা অন্ধকার আকাশে তারার মতো ‘ফুল’ ফোটাতে পারে। ‘ফুল’ অর্থে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন, মহৎ কোন সৃষ্টির কথা বলেছেন শ্রদ্ধেয় দিলীপ কুমার রায়।

যাঁর সম্পর্কে তিনি এই সুন্দর কথাটি বলেছিলেন, তিনি হলেন অতুলপ্রসাদ সেন যাঁর গান শোনেনি --- এমন বাঙালি একজনও নেই। তাঁর সেই বিখ্যাত গানগুলির কথা মনে পড়ে যায়: ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী', ‘বল বল বল সবে শত বীনা বেনু রবে', অথবা ‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর', কিংবা সেই অত্যাশ্চর্য গান, ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’। তিনি হলেন, যাঁকে বলা হয়, গীতিকবি। তাঁর গানে একদিকে যেমন রয়েছে সংগীতের অপূর্ব সুষমা, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে গানের কথায় অসাধারণ কাব্যরস। আসলে তিনি কখনোই কেবলমাত্র সুর-রচয়িতা নন, তিনি একজন অনন্যসাধারণ কবিও বটে।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাঙালি যে চারজন কিংবদন্তি সুরসাধককে পেয়েছিল, তাঁরা হলেন --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন এবং অতুলপ্রসাদ সেন। কাজী নজরুল ইসলাম এসেছেন আরো অনেক পরে। তা, গানের সংখ্যার বিচারে অতুলপ্রসাদ সেন তাঁর সমসাময়িক তিন সঙ্গীতজ্ঞের চাইতে ছিলেন বেশ পিছিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেখানে লিখেছেন প্রায় ২০০০ গান, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যেখানে লিখেছেন প্রায় 500টি গান, অথবা রজনীকান্ত সেন যেখানে লিখেছেন প্রায় ২৯০টি গান, সেখানে সেখানে অতুলপ্রসাদ সেন লিখেছিলেন ২০৬ অথবা ২০৮টি গান। কিন্তু তিনি গানের মধ্যে, গানের স্বকীয় তাল-লয় অক্ষুন্ন রেখে হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সংগীতের মূর্ছনায় বা তার মিশেলে গানের মধ্যে তিনি যে অন্তর্লীন মায়া, অন্তর্লীন মুগ্ধতা তৈরি করেছিলেন, তাঁর সেই অতুলনীয় কাজের জন্যই তিনি হয়ে রইলেন সবার থেকে আলাদা --- বাংলা সংগীত জগতের ইতিহাসে মৌলিক প্রতিভায় ভাস্বর এক নক্ষত্র।

না, তার গান নিয়ে আর কিছু বলতে পারব না। যেটুকু বুঝেছি, আপনাদের বললাম। আমি চাইছি, দিলীপ কুমার রায়ের সেই কথাটিকে অবলম্বন করতে। অতুলপ্রসাদ সেন সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, গভীর বেদনা ভালো, যদি তা আঁধারে তারার মতো ফুল ফোটাতে পারে। তাঁর এই কথা থেকে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, অতুলপ্রসাদ সেন যতই দেশাত্মবোধক গান বা ভক্তিগীতি বা প্রেমের গান লিখুন না কেন, তার গানে ব্যক্তিগত বেদনা বা যন্ত্রণার একটা গভীর প্রভাব আছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, তার অধিকাংশ গানেই করুনরস প্রধান। অর্থাৎ বেদনার আধারে বিকশিত হয়েছে তার সঙ্গীতজগত, বেদনাই তাঁর গানের আধার। তা, প্রশ্ন হল, কী তার সেই বেদনা, তাঁর সেই যন্ত্রণা, যা আঁধারে গানের ফুল ফুটিয়েছিল। আজ এই নিয়েই গল্পসল্প।

#

অতুলপ্রসাদ সেন তাঁর জীবনে প্রথম আঘাতটি পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে। মায়ের নাম ছিল হেমন্তশশী দেবী। প্রথম স্বামী রামপ্রসাদ সেন, যিনি ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেনের বাবা, তাঁর অকাল মৃত্যুর পর হেমন্তশশী দেবী ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকতেন। একদিন ছেলেমেয়েদেরকে বাপের বাড়িতে রেখে তিনি কিছু সময়ের জন্য গিয়েছিলেন বড় ভাই কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তের কাছে। সেই যে চলে গেলেন, আর তিনি ফিরলেন না। কিছুদিন পরেই খবরে জানাজানি হল, ৪৩ বছর বয়স্ক বিধবা হেমন্তশশী দেবী, যিনি চার ছেলেমেয়ের মা, তিনি বিয়ে করেছেন ৪৯ বছর বয়স্ক ব্রাহ্মনেতা দুর্গামোহন দাশকে, যিনি ছয় সন্তানের বাবা। এই দুর্গামোহন দাশ কিন্তু ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যাঠামশাই এবং অন্যদিকে, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর শশুরমশাই।

বিয়েটা হয়েছিল অত্যন্ত সংগোপনে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাজে চারিদিকে ছি-ছিক্কার পড়ে গেল। অতুলপ্রসাদ সেন গভীর আঘাত পেলেন। তীব্র যন্ত্রণায়, ভীষণ অভিমানে তিনি মায়ের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। মায়ের কাছে যাতায়াত, যোগাযোগ সব বন্ধ করলেন। যদিও পরবর্তীকালে দ্বিতীয় স্বামী দুর্গামোহন দাশের মৃত্যুর পর আশ্রয়হীন মা হেমন্তশশী দেবীকে অতুলপ্রসাদ সেন নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি মায়ের কাছ থেকে যে আঘাত পেয়েছিলেন, তা সারা জীবনে ভুলতে পারেননি। সেই ঘটনা তাঁর জীবনের বেদনার অন্যতম উৎস হয়ে রইল।

#

অনেকেই বলেছেন, অতুলপ্রসাদ সেন মায়ের প্রতি তীব্র অভিমানের কারণেই মায়ের কাছ থেকে সব সময় দূরে চলে যেতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই তিনি নাকি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা শেষ করেই অথবা পড়তে পড়তেই সোজা বিলেত চলে যান। ব্যারিস্টারি পড়তে। লন্ডনের মিডল টেম্পেলে ব্যারিস্টারি পড়া শুরু হয়েছিল।

 একদিন সেখানেই ঘটলো অদ্ভুদ ঘটনা। বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত সপরিবারে বিলেতে আসলেন। বড়মামার মেয়ে ছিলেন হেমকুসুম। অতুলপ্রসাদ সেন লক্ষ্য করেছিলেন, হেমকুসুম সুন্দরী, সুগায়িকা, সুন্দর বেহালাও বাজাতে পারেন। তাঁর বেহালা শুনতে শুনতে কখনো কখনো তিনি তন্ময় হয়ে পড়তেন, আবার কখনো কখনো যখন মায়ের জন্য মন খারাপ হতো, তখন সেই হেমকুসুমই কাছে এসে সান্ত্বনা দিতেন। আর এভাবেই শুরু হলো ভালোলাগা --- ক্রমশ দানা বেঁধে উঠলো গভীর এক ঘনিষ্ঠতা --- যাকে বলা যায়, ভাইবোনের এক নিষিদ্ধ সম্পর্ক।

*** অতুলপ্রসাদ সেন ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের গল্প : এই রচনাটিকে ভিডিওতে দেখতে নিচের ভিডিওতে ক্লিক করুন:




বেশ কয়েক বছর পরে ১৮৯৫ সালে দেশে ফিরলেন ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ সেন। কলকাতার সার্কুলার রোডে বাড়ি ভাড়া করে ওকালতির জন্য অফিস খুললেন।

একদিন কোনো ভূমিকা না করেই বাড়িতে ঘোষণা করলেন, তিনি হেমকুসুমকে বিয়ে করবেন। আত্মীয়-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী, মা, সৎবাবা -- সবাই শিউরে উঠলেন। মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন --- এ বিয়ে হয় কি করে! এ তো ঘোর অনাচার! বাধার শক্ত প্রাচীর তৈরি করলেন অতুলপ্রসাদ সেনের মা, হেমন্তশশীদেবী। শোনা যায়, অতুলপ্রসাদ সেনের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে মায়ের প্রতি তাঁর প্রতিশোধস্পৃহা নাকি কাজ করেছিল। বংশের মুখ পুড়িয়ে নিষিদ্ধ সম্পর্ক গড়তে তিনি নাকি তাই পিছপা হননি।

যাইহোক, বিয়ের ব্যাপারে একদিকে যেমন অতুলপ্রসাদ ছিলেন তুমুল নাছোড়বান্দা, তেমনি অন্যদিকে মামাতো বোন হেমকুসুমও ছিলেন পৃথিবীর যেকোনো বাধাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে প্রস্তুত। এত বছর ধরে দুটি মনের মধ্যে প্রেমের যে ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়েছে, তা স্বীকৃতি চাইছে সরবে। কিন্তু কে দেবে এই বিষম প্রেমের স্বীকৃতি? পারিবারিক বা সামাজিক ক্ষেত্রেই তো শুধু বাধা নয়, বাধা তো আইনেও। ব্রিটিশ বা হিন্দু আইনে এ দেশে এই বিয়ে কখনোই সিদ্ধ নয়। তাহলে উপায়?

 দিশেহারা উদভ্রান্ত অতুলপ্রসাদ সেনকে অবশেষে আশার আলো দেখালেন তারই সিনিয়র সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ। যিনি পরামর্শ দিলেন, “স্কটল্যান্ডে যাও। ওখানকার আইনে ভাইবোনের বিয়ে হয়।“ অতুলপ্রসাদ সেন আবার বিলেতযাত্রা করলেন, এবার সঙ্গে হেমকুসুম। স্কটল্যান্ডের গ্রেটনা গ্রীন গ্রামে তাদের বিবাহপর্ব সাঙ্গ হল। বিয়ের পর তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, দেশে আর কখনো ফিরবেন না। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন।

 লন্ডন শহরে অতুলপ্রসাদ সেনের প্র্যাকটিস জমলো না। অর্থসংকট ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হল। এরই মধ্যে ১৯০২ সালে যমজ দুই ছেলে দিলীপ কুমার ও নিলীপ কুমারের মধ্যে নিলীপ কুমারের অকাল মৃত্যু ঘটলো। ছেলের মৃত্যুতে গভীর আঘাত পেলেন অতুলপ্রসাদ সেন। অবশেষে একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থায় সপরিবারে কলকাতায় ফিরলেন অতুলপ্রসাদ। কলকাতায় ফিরলেন বটে, কিন্তু এখানে চারিদিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ নিন্দা আর সমালোচনা। আত্মীয়-স্বজন একজনও পাশে এসে দাঁড়ালেন না।

#

অবশেষে বিরক্ত বীতশ্রদ্ধ অতুলপ্রসাদ সেন কলকাতা ছাড়লেন, স্বপরিবারে চলে গেলেন লখনৌ শহরে। কিন্তু সেখানেও কি তিনি সুস্থির হতে পেরেছিলেন? হ্যাঁ, একথা সত্যি যে, লখনৌ শহরে তার পসার জমে উঠেছিল, বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, অসাধারণ সব দেশাত্মবোধক গান, ভক্তিরসের গান, প্রেমের গান লিখে, সুর দিয়ে, বাংলা ও হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের অপূর্ব মিশেশ ঘটিয়ে নতুন মৌলিক গান সৃষ্টি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শহরের বিদ্বজনেদের মাঝে অন্যতম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, -- এসবই সত্যি, শহরের কেশরবাগ অঞ্চলে সে যুগের ৩৩ হাজার টাকা দিয়ে রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ি তৈরি করেছিলেন --- এও সত্যি, কিন্তু আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও সামাজিকভাবে বিপুল প্রতিষ্ঠা পেলেও তিনি কোথাও মানসিক শান্তি, স্থিরতা অর্জন করতে পারেননি। অপ্রত্যাশিত এক যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে উঠেছিল তার জীবন। এর মূল কারণই ছিল তীব্র তীক্ষ্ণ দাম্পত্য কলহ।

 সামাজিক, পারিবারিক সমস্ত বাঁধাকে উপেক্ষা করে যাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন, সেই হেমকুসুমের সাথে সুখের সংসারিক জীবনযাপন তার পক্ষে সম্ভব হলো না। এই অশান্তির মূলকেন্দ্রে কিন্তু ছিলেন হেমন্তশশী দেবী, অতুলপ্রসাদ সেনের মা। মায়ের দ্বিতীয় স্বামী দুর্গামোহন দাশের মৃত্যুর পর অতুলপ্রসাদ সেন আশ্রয়হীন মাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। আর তখন থেকেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল সাংসারিক অশান্তির লেলিহান শিখা।

#

স্ত্রী হেমকুসুম ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা। বিয়েকে কেন্দ্র করে আত্মীয়-স্বজনদের আচরণ, বিশেষ করে শাশুড়ি হেমন্তশশী দেবীর যে শক্ত বাধা, তিরস্কার, সমালোচনা -- তা কখনোই তিনি ভুলতে পারেননি। সেজন্য তিনি কিছুতেই শাশুড়িকে সহ্য করতে পারতেন না, শাশুড়ির সঙ্গে কোন রকম সম্পর্ক পর্যন্ত তিনি রাখতে চাইতেন না। ফলে শুরু হয়েছিল শাশুড়ি-পুত্রবধূর ভয়ংকর সংঘাত। অতুলপ্রসাদ সেন সেই সংঘাতের কোন কূলকিনারা করতে পারেননি। মাকে যেমন তিনি শান্ত করতে পারেননি, তেমনি মায়ের বিষয় নিয়ে স্ত্রীরও মনও জয় করতে পারেননি। মাঝখান থেকে তিনি হয়েছেন বারবার গভীর যন্ত্রণাবিদ্ধ। অবশেষে স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, লখনৌ শহরে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে তিনি থাকতে শুরু করলেন।

একই শহরে তারা রয়েছেন আলাদা আলাদা বাড়িতে, অথচ তাদের মধ্যে ছিল ভালোবাসার পূর্ণপাত্র। এমনও হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য বাসর বা গানের আসর, স্ত্রী হেমকুসুম এসে সমস্ত আয়োজন করেছেন হাসিমুখে, নিজের হাতে। আবার অনুষ্ঠান শেষে ফিরে গিয়েছেন সেই ভাড়াবাড়িতেই। আবার কখনো স্বামী অসুস্থ হয়েছেন, স্ত্রী ছুটে এসেছেন, শুশ্রুষা করেছেন। আবার স্ত্রী অসুস্থ হয়েছেন, স্বামী ছুটে এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু সে সবই ছিল সাময়িক, আসলে দাম্পত্য সম্পর্কে যে চিড় ধরেছিল, তা কিন্তু কখনোই আর জোড়া লাগেনি। বিচ্ছেদের সেই সুদীর্ঘকালে স্ত্রীর কন্ঠে ঠাঁই পেতো স্বামী অতুলপ্রসাদেরই গান। অতুলপ্রসাদ সেনও বহু বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন চোখের জলে, গান লিখে আর গান গেয়ে। মনে পড়ে যায় তার সেই বিখ্যাত গান:

“বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখিপাতে

আমিও একাকী তুমিও একাকী

আজি বাদল রাতে।“

অতুলপ্রসাদ সেন সারা জীবন ধরে সাংসারিক হলাহল পান করেছিলেন ঠিকই কিন্তু বহিরঙ্গে তিনি ছিলেন লখনৌ শহরের সারস্বত সমাজের নক্ষত্র, এক দিল দরিয়া মানুষ। তিনিই স্ত্রীর বিরহ বেদনায়, বিচ্ছেদ বেদনায় যেমন কাতর হয়েছেন, যন্ত্রণায় নীল হয়েছেন, তেমনি অন্যদিকে তাঁর সেই যন্ত্রণা থেকেই তিনি সৃষ্টি করেছেন নক্ষত্রের মতো অজস্র গান। বাস্তবিকই, বেদনাই তার গানের একমাত্র আধার।

জীবনের অপরাহ্নে ক্ষতবিক্ষত দাম্পত্যের বেদনাতেই তাঁর জীবনী শক্তির ক্ষয় হয়েছিল। একেবারে শেষের দিকে তিনি হাওয়া বদলের জন্য পুরী গিয়েছিলেন। পুরী থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরলেও আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। লখনৌএর বাড়ি “হেমন্তনিবাসে” একে একে সবাই তাঁকে দেখতে আসলেন, কিন্তু স্ত্রী হেমকুসুম, তিনি আসলেন না। অবশেষে সমস্ত অভিমান ভুলে হেমকুসুম যখন আসলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তখন আর তিনি এই ইহলোকে নেই, শুধু পড়েছিল তার নিষ্প্রাণ নিথর দেহ।

১৯৩৪ সালের ২৬শে আগস্ট ৬৩ বছর বয়সে অতুলপ্রসাদ সেন গভীর রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই তাঁর দীর্ঘ দুঃখ যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটলো, যে দুঃখ, যে যন্ত্রনা তাঁকে সৃষ্টির পথে চালিত করেছিল আজীবন।

আজ ২০ শে অক্টোবর তাঁর জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।

তথ্যঋণ:

1. প্রিয়জনের প্রিয়তমা by পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

2. আজীবন বিষাদ বেদনায় তাঁর গানের আধার by কৃষ্ণা রায় (প্রবন্ধ)

3. আমিও একাকী তুমিও একাকী (প্রবন্ধ)

4. অক্লান্তকণ্ঠ এক সঙ্গীত সন্ন্যাসী তিনি (প্রবন্ধ)

5. কেচ্ছা by সুস্নাত চৌধুরী (প্রবন্ধ)

6. আনন্দবাজার পত্রিকা

7. উইকিপিডিয়া


Further Study:

1. অতুল কথা by দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত (প্রবন্ধ : নবকল্লোল, নভেম্বর ২০২১)

2. তুমি তো আমার রহিবে by পায়েল সেনগুপ্ত (প্রবন্ধ : সানন্দা, সেপ্টেম্বর ২০২২)


#অতুলপ্রসাদ #atulprasad #atulprasadsen


*** রচনাটি ভিডিওতে দেখতে নিচের ভিডিওতে ক্লিক করুন।


কপিরাইট : The Galposalpo

Published : 20th October, 2022


Comments

Popular posts from this blog

সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য : জীবনী বা জীবন কাহিনী / Sadhak Kamalakanta Bhattacharya Life Story or Biography

অদ্বৈত মল্লবর্মণ এক অসামান্য নদীর নাম : অসামান্য জীবনী / Adwaita Mallabarman Life Story