সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য : জীবনী বা জীবন কাহিনী / Sadhak Kamalakanta Bhattacharya Life Story or Biography
This is about Sadhak Kamalakanta Bhattacharya Life Story ( সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য : জীবন কাহিনী ) or his biography (সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য : জীবনী)
মহামায়া দেবী এবং মহেশ্বর ভট্টাচার্য --- মা ও বাবা ----- দুজনেই উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁদের ছেলে কমলাকান্ত বড় হয়ে মহাপন্ডিত হবে, বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। কেন তাঁদের এমন ধারণা? এই কারণে যে, বাবার কাছে কমলাকান্ত যা পড়তেন, যা শুনতেন -- তা কখনো তিনি ভুলতেন না অর্থাৎ ছোট থেকেই কমলাকান্ত ছিলেন স্মৃতিধর ও শ্রুতিধর। তাছাড়া, তাঁর গানের গলাও ছিল অত্যন্ত সুমিষ্ট। উপরন্তু, বর্ধমানের তৎকালীন অম্বিকা-কালনা অঞ্চলের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি তার অন্তরের টান বা ভালবাসা ছিল প্রগাঢ়। এই সমস্ত লক্ষণ গুলিকে মা-বাবা চিনতেন এবং জানতেন।
কিন্তু দুঃখের কথা, বালক কমলাকান্তের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি বাবা মহেশ্বর ভট্টাচার্য, কারণ কমলাকান্তের বাল্যবয়সেই তিনি মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর মা মহামায়া দেবী তার দুই ছেলে --- কমলাকান্ত ও শ্যামাকান্ত ---- তাঁদেরকে নিয়ে অম্বিকা-কালনার স্বামী-শ্বশুরের ভিটেমাটি ছেড়ে সম্পূর্ণ সহায়সম্বলহীন অবস্থায় বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। বাপের বাড়ি ছিল বর্ধমানেরই অন্তর্গত চান্না গ্রামে।
সেখানে কোনক্রমে দিনগুজরান করতে করতে মা ভাবলেন, কমলাকান্তকে যদি পুজোপাঠ শেখানো যায়, শাস্ত্রবিদ্যা শেখানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে যজমানগিরি করে, টোল-চতুষ্পাঠি খুলে কমলাকান্ত রোজগারপাতি করতে সক্ষম হবেন। সেই চিন্তাভাবনা অনুযায়ী, বালক কমলাকান্তকে অম্বিকা গ্রামে এক যজমানের কাছে পাঠানো হলো। যজমান তাকে টোলে ভর্তি করে দিলেন। টোলের পন্ডিতমশাই অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর এই নতুন ছাত্রটির মেধা ও স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। ব্যাকরণ, কাব্য, সাহিত্য -- যা একবার শোনে, যা একবার পড়ে – তাকে সে হুবহু মনে রাখতে পারে।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই পন্ডিতমশাই কিন্তু বেশ অসন্তুষ্ট হলেন, এই কারণে যে, তাঁর এই নতুন ছাত্রটি বেশিরভাগ দিনই টোলে উপস্থিত না থেকে বনে-বাঁদারে, নদীর ধারে আপন মনে ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝেই নিজের খেয়ালে সে গান করে। এসব তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। একদিন ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি ছাত্রটিকে বললেন, আজ যদি আমার সব প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারো তবে কড়া শাস্তি পাবে।
কিন্তু কি আশ্চর্য! সেদিন পন্ডিতমশাইয়ের সব প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিয়ে দিলেন ছাত্র কমলাকান্ত। বিস্মিত পন্ডিতমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, পাঠের সময় তুমি তো উপস্থিত থাকো না, তবে কি করে সঠিক উত্তর দিলে? বালক কমলাকান্তের সরল জবাব ছিল, আমার তো সব মনে থেকে যায়। আমি সব জানি।
পন্ডিতমশাই উপলব্ধি করলেন, এই ছাত্রটি কোন সাধারণ ছেলে নয়। এরপর থেকে আর কখনো তিনি জোর করে ছাত্রটিকে টোলে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন নি।
Sadhak Kamalakanta Bhattacharya Life Story ( সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য : জীবন কাহিনী : এই বিষয়টিকে ভিডিওতে দেখার জন্য নিচের ভিডিওতে ক্লিক করুন :
অম্বিকা কালনায় টোলের পাঠপর্ব শেষ হলে কমলাকান্ত ফিরে এলেন মায়ের কাছে -- চান্না গ্রামে। গ্রামে ফিরলেন বটে, কিন্তু বাড়িতে আর কতক্ষণ! সারাক্ষণ পড়ে থাকেন গ্রামেরই এক প্রান্তে নির্জন বনের মধ্যে বিশালাক্ষী দেবীর মন্দিরে। সেখানে মাতৃসাধনার গান গেয়েই তাঁর সময় কেটে যায়। অধিকাংশ সময়ে তিনি গাইতেন রামপ্রসাদী গান। কখনো গাইছেন, "ডুব দে রে মন কালি বলে", আবার কখনও গাইছেন, "আমায় দাও মা তবিলদারি।"
প্রসঙ্গত, আপনাদের বলে রাখি, ষোল শতকে ভক্তিবাদী আন্দোলনের পুরোধা শ্রী চৈতন্যদেবের রহস্যজনক অন্তর্ধানের প্রায় ১৯০ বছর পরে গৌড়-বাংলার মাটিতে দু-দুজন মহাসাধকের আবির্ভাব ঘটেছিল। একজন ছিলেন হালিশহরের মাতৃসাধক রামপ্রসাদ সেন এবং অন্যজন হলেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী অম্বিকা-কালনার মহাসাধক, আমাদের আজকের আলোচ্য আচার্য পুরুষ, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বর্ধমানের অম্বিকা-কালনা অঞ্চলে আনুমানিক ১৭৭২ সালে, সাধক রামপ্রসাদ সেনের মৃত্যুর চার-পাঁচ বছর আগে।
#
আপনার অনেকে হয়তো জানেন, বিশ শতকের প্রথম দিকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর উদ্যোগে বাংলার প্রাচীন পুঁথিপত্রের তত্ত্বতলাশের খোঁজখবরের একটা কাজ শুরু হয়েছিল। সে সময় বেশ কয়েকজন পন্ডিতের উদ্যোগে গ্রামবাংলার মঠ-মন্দির থেকে, ব্যক্তি মানুষের সংগ্রহ থেকে অনেক লুপ্তপ্রায় পুঁথি উদ্ধার করা হয়েছিল। সেই সব উদ্ধার করা পুঁথির মধ্যে চান্না গ্রামের বিশালাক্ষী মন্দির থেকে উদ্ধার করা একটি পুঁথি ছিল অন্যতম। পুঁথিটির নাম ছিল “সাধক রঞ্জন”। কে লিখেছিলেন সেই পুঁথিটি? হ্যাঁ, লিখেছিলেন আঠারো শতকের বিশিষ্ট মাতৃসাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য।
তা, সেই পুঁথিটি থেকে জানা যায় যে, বর্ধমানের চান্না গ্রাম সাধক কমলাকান্তের মাতুলালায়। গ্রামের বিশালাক্ষী মন্দিরটি প্রায় ৫০০ বছর আগে বর্ধমানের কোন ধনী ব্যক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। সেই মন্দিরের পাশেই প্রবাহিত খড়ি বা খন্ডেশ্বরী নদী। তা, সেই নদী, নদীর পাশে বিশালাক্ষী মন্দির, নির্জন বনভূমি, রামপ্রসাদী গান ----- এসবই মিলেমিশে কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের মধ্যে তৈরি করেছিল সাধনার এক উর্বর মনোভূমি।
#
অনুমান করা হয় যে, টোল থেকে চান্না গ্রামে ফিরে আসার পর তাঁর উপনয়ন অর্থাৎ পৈতেধারণের অনুষ্ঠান হয়েছিল এবং সেই অনুষ্ঠানের পরেই শ্রীপট গোবিন্দমঠের বৈষ্ণব চন্দ্রশেখর গোস্বামীর কাছে তিনি বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল।
দীক্ষা গ্রহণের পর তার মধ্যে প্রবল বৈরাগ্য ভাবের আবির্ভাব ঘটে। সেসব লক্ষ্য করে মা মহামায়া দেবী কিন্তু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি দ্রুত পার্শ্ববর্তী লাজুকা গ্রামের এক ভট্টাচার্য বাড়ির সুন্দরী সুলক্ষনা একটি মেয়ের সাথে কমলাকান্তের দিয়ে দেন, যদি ছেলেকে সংসারী করা যায়। কিন্তু বিয়ের পরেও কমলাকান্তের হাবভাবের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটল না। বরং দেখা গেল, গ্রামের বিশালাক্ষী মন্দিরে দেবী মূর্তির সামনে তার সাধন ভোজনের সময় আরো বেড়েছে। অধিকাংশ সময় তিনি সেখানে ধ্যানস্থ হয়ে থাকছেন।
ইতিমধ্যে স্বামী সঙ্গ না পাওয়ার কারণে বা অন্য কোন কারণে স্ত্রী বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং অচিরেই মৃত্যুমুখে উপস্থিত হলেন। মায়ের আদেশ মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীকে কমলাকান্ত মাতৃসাধনার গান শোনালেন। অবশেষে স্ত্রীর মৃত্যু হল।
শোনা যায়, খড়ি নদীর পারে বালিয়াড়ি শ্মশানে যখন স্ত্রীর চিতা জ্বলছিল, তখন নাকি কমলাকান্ত নাচতে নাচতে মাতৃসাধনার গান গাইছিলেন। সে দৃশ্য দেখে উপস্থিত শ্মশান বন্ধুরা বিস্মিত হয়েছিলেন। সেদিন তিনি যে গানটি গাইছিলেন, সেটি হল:
“কালী সব ঘুচালি ল্যাঠা
শ্রীনাথের লিখন আছে যেমন
রাখবি কিনা রাখবি সেটা।“
#
এখানে একটা কথা বলে রাখি, অনেক জীবনীকাররা বলেন, সাধক কমলাকান্ত শ্মশানে বসে এই গানটি নাকি গেয়েছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পর। মা মহামায়া দেবীই ছেলেকে সংসারের বাঁধনে বাধার জন্য শেষ চেষ্টা হিসেবে দ্বিতীয় বারের জন্য আবার ছেলেকে বিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য সেই বিয়ের দিনক্ষণের কিন্তু প্রামাণ্য কোন নথি পাওয়া যায়নি। শুধু জানা যায়, দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তার একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছিল। বলাবাহুল্য, সন্তানের জন্মের পরেই কমলাকান্ত ভট্টাচার্য কিন্তু রোজগারপাতিতে মন দিয়েছিলেন, অর্থাৎ বাড়ি বাড়ি গিয়ে যজমানি করা, পুজোপাঠ করা ইত্যাদি কাজে তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন। এমন কি, তিনি শেষ পর্যন্ত টোল খুলে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছিলেন।, যদিও কোন কাজই তিনি সুষ্ঠুভাবে শেষ পর্যন্ত সম্পাদন করতে পারেন নি।
এই যে তিনি কোন কাজেই সফল হলেন না, এর মূল কারণ কিন্তু ছিল জীবনের এই পর্বে তাঁর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল। সেটা কী? সেটা হল এই যে, তিনি বৈষ্ণব মতে দীক্ষিত হলেও এই সময় থেকে তিনি তন্ত্রসাধনার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। এখানে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, বংশ পরম্পরায় তাঁরা কিন্তু ছিলেন শাক্ত অর্থাৎ শক্তির উপাসক বা মা কালীর উপাসক। সেজন্য, শাক্ত হওয়া সত্বেও কিশোর বেলায় তিনি যে বৈষ্ণব মতে দীক্ষিত হয়েছিলেন, সেই ঘটনাটি ছিল বেশ ব্যাতিক্রমী ঘটনা।
যাইহোক, চান্নার পাশের গ্রাম ছিল শুধড়ে গ্রাম। সেই গ্রামে কালী পুজো দেখতে এসেছিলেন গরমানকর গ্রামের বিশিষ্ট মাতৃসাধক কেনারাম চট্টোপাধ্যায়। কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সেই মাতৃসাধকের কাছে শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষিত হলেন। অনেকে অবশ্য বলেন, তাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন কালিকানন্দ ব্রহ্মচারী।
#
দীক্ষা নেওয়ার পর শুরু হল তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিশালাক্ষী মন্দিরের পঞ্চমুন্ডীর আসনে সদা ধ্যাননিমগ্ন সাধক কমলাকান্ত তন্ত্রসাধনার উচ্চস্তরে আসীন হলেন। এই পর্বে কিন্তু বাগ্দী মেয়ে হিসেবে মা কালীর আগমন, কন্যার বেশে মা কালীর দর্শন ইত্যাদি অনেক অলৌকিক ঘটনার কথা লোকমুখে ছড়িয়ে যায়। সে সব ঘটনায় আমি যাচ্ছি না।
গভীর তন্ত্রসাধনার পাশাপাশি কেনারাম চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিনি মাতৃসঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। এই সময় থেকেই বিভিন্ন শাক্ত পদাবলী ও মাতৃসংগীত রচনার মধ্যে দিয়ে তাঁর কবিত্বশক্তি, তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। ২৫০এর উপরে ভক্তিগীতি তিনি রচনা করেছিলেন। “সাধক রঞ্জন” নামে তার তন্ত্রসাধনা বিষয়ক সেই পুঁথিটির নামও কাব্যকীর্তি হিসাবে এখানে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আপনারা জানেন, পরবর্তীকালে বাংলা শাক্ত পদাবলীর অন্যতম একজন উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে তিনি স্বীকৃত হন। তবে মনে রাখা দরকার যে, শাক্ত মতের পাশাপাশি বৈষ্ণবীয় মতের পদও তিনি রচনা করেছিলেন। আগমনী ও বিজয়পদে তিনি তাঁর অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। অনেকেই মনে করেন, সাধনায় ও কবিত্ব শক্তির নিরিখে সাধক কমলাকান্ত পূর্বসূরী সাধক রামপ্রসাদ সেনের সমকক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
তা, কথিত আছে যে, মায়ের মৃত্যুর পর তিনি চান্না গ্রামের বিশালাক্ষী মন্দিরে পঞ্চমুন্ডীর আসনে বসে শক্তিসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তার সিদ্ধি লাভের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে একদিন বর্ধমানের মহারাজা তেজশচন্দ্র, তিনি এলেন, সাধকের কাছে শুনতে চাইলেন মাতৃসংগীত। সেদিন এক অনবদ্য ভাবসুরে স্বরচিত একটি বিখ্যাত গান সাধক কমলাকান্ত শুনিয়েছিলেন:
“আপনারে আপনি দেখ, যেও নাকো মন কারু ঘরে
যা চাবে এইখানে, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।“
#
সাধক কমলাকান্তের সৌম্যদীপ্ত চেহারা তার আধ্যাত্মিক তেজ ভাবরসের গান তার কন্ঠের মাধুর্য এসব কিছুতে অভিভূত হলেন মহারাজ তেজসচন্দ্র। অবশেষে তিনি মহাসাধকের কাছে শাক্তমন্ত্রে দীক্ষিত হলেন। এখানে কিন্তু ‘অমাবষ্যায় পূর্ণিমার চাঁদ দর্শন' --- এরকম বিভিন্ন অলৌকিক কাহিনী লোকমুখে শোনা যায়, সেসব ঘটনা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। সে সব অন্য সময়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
যাইহোক, ইতিমধ্যে সাধক কমলাকান্ত মহারাজের অনুরোধে রাজদরবারে সভাপন্ডিতের পদ গ্রহণ করলেন এবং বর্ধমানের বাঁকা নদীর তীরে কোটালহাটে মহারাজ তেজশচন্দ্র নির্মিত কালীমন্দিরে তিনি বসবাস করতে শুরু করলেন। বলাবাহুল্য, বর্ধমানের মহারাজের আগমনের পরে সাধক কমলাকান্তের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। এই নতুন অধ্যায়ে সাধক কমলাকান্ত কিন্তু অধিকাংশ সময়ে কোটালহাটের কালীমন্দিরেই জীবন অতিবাহিত করেছেন। এই কালীমন্দিরে থাকাকালীন সময়েই মহারাজ তেজসচন্দ্রের ছেলে প্রতাপচাঁদ সাধক কমলাকান্তের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন।
#
প্রসঙ্গত, আপনাদের এখানে বলা দরকার যে, সিদ্ধসাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের প্রাত্যহিক জীবনচর্যায় এবং তার রচিত মাতৃসংগীতে প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর মহামূল্য জীবনদর্শন। তাঁর জীবনদর্শনের মূল কথাই ছিল এই যে, জগতস্রষ্টা ঈশ্বর, তিনি হলেন তাঁর কাছে মাতৃসরূপা। অর্থাৎ ঈশ্বরকে তিনি মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার মাতৃসাধনার মূল ভিত্তি গভীর প্রেমভক্তি, যা থাকলে ভক্তের মনে উদারতা জেগে ওঠে, ঘুচে যায় মনের সমস্ত ভেদবুদ্ধি আর সংকীর্ণতা। বলাবাহুল্য, এই অবিচল প্রেমভক্তি নিয়ে মাতৃরূপের আরাধনা করাই, সাধনা করাই হলো তার তন্ত্রসাধনার মূল লক্ষ্য।
তাঁর তন্ত্রসাধনা কিন্তু ছিল তান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী গূঢ়, গুহ্য, চরম গোপনীয়। তবে জনসমক্ষে তার তন্ত্রসাধনার দুটি ক্রিয়াপদ্ধতি বেশ আলোচনার বিষয় ছিল। এক. তাঁর কারণবারি সেবন বা সুরাপান; আর দুই হল তাঁর পশুবলি অনুষ্ঠান। কথিত আছে, কালীপূজার সময় তিনি অত্যাধিক কারণবারি সেবন করতেন। অন্যদিকে, পূজার সময় পশুবলীকে তিনি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে, পশুবলির ক্ষেত্রে ছাগবলি হবে নাকি মোষ বলি হবে, তা তিনি নির্দিষ্ট করে দিতেন।
তা, সুরা পান নিয়ে একসময় বহুল প্রচলিত অথচ অধুনা-বিস্মৃত একটি গল্প আছে। এই গল্পটিই শুধুমাত্র এখানে বলতে চাই, কারণ এই গল্পটির সাথে পরবর্তী ঘটনাসমূহের একটা সূত্র আছে। এবার সেই অবিশ্বাস্য গল্পটি বলি।
#
একবার কাশী থেকে একজন বাঙালি ভদ্রলোক কোটালহাটের কালীমন্দিরে উপস্থিত হলেন। সাধক কমলাকান্তকে তিনি করজোড়ে বললেন, কাশীর বাঙালিরা একটা বেশ বড় করে কালীপুজো করতে উদ্যোগী হয়েছে। তাদের ইচ্ছে, সেই কালীপুজো করবেন বাংলারই কোন সিদ্ধসাধক। প্রবাসী সেই বাঙ্গালীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ এটাই যে, সাধক কমলাকান্ত, তিনি যেন কাশীর সেই কালীপুজোর দায়িত্ব নেন।
সব কথা শুনে কমলাকান্ত ভট্টাচার্য কাশী যেতে রাজি হলেন। কাশীতীর্থ ভ্রমণ করবেন, এরকম একটা সুপ্ত ইচ্ছেও তাঁর মনের মধ্যে ছিল।
কালীপুজোর নির্দিষ্ট দিনে কাশীতে বিশাল সাড়া পড়ে গেল। পুজোর মন্ডপে সকাল থেকেই ধর্মপ্রাণ মানুষজনদের ভিড়। মধ্যরাতে তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী শুরু হল কালীপুজো। বেশ কিছুক্ষণ পূজোর অনুষ্ঠান চলার পরেই উপস্থিত অনেক দর্শকদের মনে হলো যে, সাধক কমলাকান্ত অকারণে অত্যাধিক কারনবারি বা সুরা পান করছেন। দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চস্বরে বলতে শুরু করলেন যে, কালীপুজোর নামে তান্ত্রিকঠাকুর তো শুধু মদ্যপান করেই চলেছেন। এভাবে চললে আজ আর এই পূজোতে মায়ের বিগ্রহে প্রাণের সঞ্চার হবে না।
অবিশ্বাসী সেই সব মানুষজনদের কথায় হঠাৎ সাধক কমলাকান্তের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি পূজোর আসন ছেড়ে দর্শকদের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলেন, তোরা মাটির মূর্তিকে জীবন্ত দেখতে চাস। দেখ তাহলে। কথাগুলো বলেই তিনি পাশে রাখা বলি দেওয়ার খাঁড়াটি দিয়ে মা কালীর মাটির মূর্তির হাতে সজোরে আঘাত করলেন। আঘাত পেয়েই হাতের সেই অংশটি ভেঙে চুরমার। আর সেই ভাঙ্গা অংশ থেকে আচমকা বেরিয়ে আসলো তাজা রক্ত।
ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত দর্শকরা তো একদম হতবাক। পরক্ষণেই তারা সাধক কমলাকান্তের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ক্ষমা চাইল। কিন্তু কমলাকান্ত ভট্টাচার্য তখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে সেই পুজোর মণ্ডপ ছেড়ে, পুজো ছেড়ে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন।
বলাবাহুল্য, এই ঘটনার পর তিনি একমাত্র বীরভূমের তারাপীঠের কালীমন্দির ছাড়া আর কোন তীর্থস্থান কখনো ভ্রমণ করেননি। বরং তীর্থভ্রমণের কথা উঠলেই তিনি গানে গানে উচ্চারণ করতেন তার সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা: “তীর্থ গমন দুঃখ ভ্রমণ।“
#
কাশী থেকে ফিরে আসার পর সাধক কমলাকান্ত মানসিকভাবে সবল থাকলেও শারীরিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েন। যদিও সব সময় তিনি ধ্যানতপস্যা শাস্ত্রপাঠ নামজপ কাব্যরচনা সঙ্গীতসাধনা -- এসব নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন, তথাপি সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য তিনি শাক্ত ও বৈষ্ণব উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সমন্বয়ী এক উদার ধর্মসাধনার কথা তার মাতৃসাধনার মাধ্যমে প্রচার করেছিলেন।
অবশেষে আনুমানিক ১৮২৯ সালে এই বিশিষ্ট মাতৃসাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য ৪৯ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অবশ্য কোন কোন জীবনীকারদের মতে সাধক কমলাকান্ত ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। মা কালী আরাধনার ক্ষেত্রে এই বিশিষ্ট সাধক কবির কর্মপদ্ধতি, কার্যকলাপ, তাঁর সাধনা, তাঁর ভক্তিগীতি --- সমস্তই বাঙালি ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে চিরকাল যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, অনুসরণযোগ্য হয়ে থাকবে, সে কথা বলার অপেক্ষায় রাখে না।
কালীপুজো উপলক্ষে সবার জন্য রইল আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। ভালো থাকুন। নমস্কার।
...........................................................................
তথ্যঋণ:
১) সাধক কমলাকান্ত
By গৌরী মিত্র
২) কমলাকান্ত পদাবলী
Published by শ্রীশ্রীকান্ত মল্লিক
৩) উইকিপিডিয়া
Sadhak Kamalakanta Bhattacharya Life Story ( সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য : জীবন কাহিনী : এই বিষয়টিকে ভিডিওতে দেখার জন্য নিচের ভিডিওতে ক্লিক করুন :
Copyright: The Galposalpo
Date: 24.10.22
Comments
Post a Comment