অদ্বৈত মল্লবর্মণ এক অসামান্য নদীর নাম : অসামান্য জীবনী / Adwaita Mallabarman Life Story
This article is about : Adwaita Mallabarman Life Story (অদ্বৈত মল্লবর্মণ এক অসামান্য জীবন কাহিনী)
সাহিত্যিক-প্রকাশক সুবোধ চৌধুরী সেদিনের সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ছাত্রটি ছিল ভীষণ মেধাবী। কিন্তু এতই গরিব ঘরের ছেলে যে, নিজেদের খরচে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার কোনো সামর্থ্যই তাঁর ছিল না।
শোনা যায়, পাড়ার মালোরা অর্থাৎ জেলেরা, তাঁরাই পালা করে চাঁদা তুলে ছাত্রটিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পড়তে পাঠিয়েছিল। কেন, চাঁদা তুলে কেন? আসলে জেলেদের স্বপ্ন ছিল, জেলেদের এই মেধাবী ছাত্রটি হবে তাঁদের দুঃখের জীবনের মুক্তিদাতা।
সেদিনের সেই জেলে পরিবারের মেধাবী ছাত্রটি আর কেউ নন, তিনি হলেন অদ্বৈত মল্লবর্মন, যিনি বাংলা সাহিত্যের আকাশে ‘তিতাস একটি নদীর নাম' এই ধ্রুপদী উপন্যাসটির জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
Adwaita Mallabarman Life Story (অদ্বৈত মল্লবর্মণ এক অসামান্য জীবন কাহিনী) --- এই রচনাটি ভিডিওতে দেখতে নিচের ভিডিওতে ক্লিক করুন:
সামাজিক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে জীবনের কোন পর্বেই অদ্বৈত মল্লবর্মণ কখনোই স্বস্তিতে ছিলেন না। শৈশবে তিনি একে একে হারিয়েছেন মা, বাবা আর দুই ভাইকে। মালোজীবনের নিদারুণ অসহায় অবস্থার মধ্যেই মালোদের সাহায্যের অর্থে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রথম মাইনর স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন ক্লাসের ফার্স্ট বয়। বেশিরভাগ সময়ে তিনি যখন ধূলিধূসরিত পায়ে স্কুলে আসতেন, তাঁর বন্ধুরা, তাঁর শিক্ষকরা --- অনেকেই আন্দাজ করতেন যে, ছাত্রটি উপোস করে রয়েছে। যদি কেউ তাঁকে খাওয়াতে চাইতেন, তিনি অত্যন্ত নম্রভাবে তা প্রত্যাখ্যান করতেন।
ক্লান্তি বা অনাহারের কাছে তিনি কখনো আত্মসমর্পণ করেন নি। এমনকি, প্রলোভনকেও তিনি জয় করেছিলেন। কলেজে পড়ার সময় মালোসমাজের এক ধনী ব্যক্তির মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, নিশ্চিত নিরাপদ সামাজিক আশ্রয়ের সাথে সাথে তাঁর পড়াশুনার জগতকেও কন্টকমুক্ত করার বিনিময়ে মেয়েকে সুপাত্রস্থ করা। কিন্তু তিনি কখনোই সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। তবে দারিদ্রের প্রবল কষাঘাতে ১৯৩৪ সালের মে-জুন মাসে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায়, তাঁর কলেজের পড়াশুনায় স্থায়ী ছেদ পড়ে যায়।
এরপর বছরখানেকের মধ্যেই জীবিকার সন্ধানে কুমিল্লা থেকে তিনি পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসেন।
তিনি যখন ক্লাস ফাইভের ছাত্র ছিলেন, তখন থেকেই তাঁর লেখালেখির জীবন শুরু হয়েছিল। অল্প বয়েস থেকেই তিনি ছিলেন বেশ কল্পনাপ্রবণ। স্কুলের ছাত্র থাকার সময়েই গল্প কবিতা প্রবন্ধ লিখে তিনি পেয়েছিলেন নানা পুরস্কার। ১৩-১৪ বছর বয়েস থেকেই তার কবি পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। ‘মাসপয়লা', ‘খোকাখুকু’, ‘শিশুসাথী' প্রভৃতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো এটাই যে, সেই পর্বে তাঁর সাহিত্যে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর শোষিত মালোদের দুর্বিষহ জীবনের কথাই প্রাধান্য পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি। বলাবাহুল্য, পরবর্বতী কালে সেই মূলধারা তাঁর লেখনিতে অক্ষুন্ন ছিল।
যাইহোক, অসাধারণ এক সাহিত্যপ্রতিভা নিয়ে তিনি কলকাতায় এলেন ১৯৩৪ সালে।
১৯৩৪ সালে কলকাতায় ‘ত্রিপুরা হিতসাধনী সভা’র মুখপত্র ‘ত্রিপুরা’ পত্রিকায় তিনি একটি কাজ পেলেন। কিন্তু খুব বেশিদিন সেখানে তিনি কাজ করেন নি।
১৯৩৫ সালে সাপ্তাহিক ‘নবশক্তি' পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে পূর্ণ উদ্যমে তিনি কাজ শুরু করলেন। সম্পাদক ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সাগরময় ঘোষ তার ‘সম্পাদকের বৈঠকে' বইটিতে লিখেছেন, ‘প্রেমেন্দ্র মিত্র নামেই সম্পাদক। পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব একা অদ্বৈত মল্লবর্মনের ঘাড়ে।‘
১৯৩৮ সালে অদ্বৈত মল্লবর্মন নবশক্তি পত্রিকার সম্পাদক পদে উন্নীত হলেন। একটানা তিন বছর সেই পদে তিনি কাজ করলেন।
১৯৪১ সালে অর্থের অভাবে 'নবশক্তি' পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হল। সে বছরেই তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী' পত্রিকায় যোগ দিলেন। সে সময় তিনি ‘দৈনিক আজাদ' পত্রিকাতেও কাজ করেছিলেন।
১৯৪৫ সালে ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘রক্তনিশান' শিরোনামে চারটি কবিতায় ব্রিটিশ-বিরোধী বক্তব্য থাকায় পত্রিকার পরিচালকমন্ডলীর সাথে তাঁর মতান্তর হয়। পরিণামে তিনি ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।
১৯৪৫ সালেই সাগরময় ঘোষের সহযোগী হিসাবে তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় যোগ দেন এবং আজীবন ‘দেশ' পত্রিকায় তিনি কর্মরত ছিলেন।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে তিনি একদিকে যেমন কবিতা লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, তেমনি তিনি অন্যদিকে লিখেছেন উপন্যাস, রম্যরচনা এবং অজস্র গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। তিনি অসাধারণ অনুবাদের কাজও করেছেন। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘জীবনতৃষা’ নামে রচনাটি তার অনবদ্য অনুবাদের কাজ। বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক আর্ভিং স্টোন চিত্রশিল্পী ভ্যান গগের জীবনী অবলম্বনে লিখেছিলেন ধ্রুপদী উপন্যাস ‘লাস্ট ফর লাইফ’। সেই উপন্যাসেরই অনুবাদ ছিল ‘জীবনতৃষা’। অনুবাদের কাজটি এমনই উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল যে, অনেকে বিতর্ক করেছিলেন এই বলে যে, অনুবাদ হলেও রচনাটিকে একটি মৌলিক কীর্তি বলে চিহ্নিত করা হোক।
কবিতার ক্ষেত্রে, সমালোচকরা বলেন, কবিতার কারুকার্যের দিকে তিনি আলাদাভাবে মনোযোগ দিতে পারেননি, তবে মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে তাঁর কবিতার নিজস্ব সংকেত-ঋদ্ধ ভাষা।
আর তিনি বেশ কয়েকটি গল্পও লিখেছিলেন। সেই গল্পগুলির মধ্যে চারটি গল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
সন্তানিকা, স্পর্শদোষ, বন্দিবিহঙ্গ এবং কান্না।
সাহিত্য সমালোচকদের মতে প্রতিটি গল্পই হল জীবন-ঘনিষ্ঠ। তবে তার গল্পের সংখ্যা বেশি ছিল না বলে, বাংলা ছোটগল্পের ধারাবাহিকতায় গল্পকার হিসেবে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কোন সুনিশ্চিত যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এক্ষেত্রেও তাঁর সৃষ্টিকর্মের কক্ষপথ ছিল একদমই স্বতন্ত্র।
তবে তাঁর প্রবন্ধগুলি ছিল সবই গবেষণাধর্মী, গভীর বিশ্লেষণী শক্তিতে সমৃদ্ধ। লোকসংস্কৃতি, লোকভাষা, লোক-জীবনপ্রণালী -- এই সব কিছুর তিনি ছিলেন একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক ও সংগ্রাহক। পল্লীজীবনের লুপ্ত সম্পদ সংরক্ষণে তাঁর নিষ্ঠা ও আগ্রহ ছিল অপরিসীম। লোকসংস্কৃতি ও লোকজীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখেছেন এমন কিছু প্রবন্ধ, যা বাংলা সাহিত্যে আজও উজ্জ্বল সম্পদ হয়ে আছে।
তাছাড়া, তিনি ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির একজন বিশ্বপথিক। দেশ পত্রিকায় লিখেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা কবি টি এস এলিয়ট সম্পর্কে সুচিন্তিত প্রবন্ধ। তেমনি লিখেছেন চীন দেশের চিত্রকলা নিয়ে ‘প্রাচীন চীনা চিত্রকলার রূপ ও রীতি'। অনুবাদ সাহিত্য ‘জীবনতৃষা’র পাশাপাশি লিখেছেন লেখক কার্ল কাপেককে অনুসরণ করে রম্যরচনা ‘নাটকীয় কাহিনী’। আবার ‘গুড আর্থ' উপন্যাসের লেখিকা পার্ল বাককে দিদি সম্বোধন করে তিনি লিখেছেন অসাধারণ মননশীল এক প্রবন্ধগ্রন্থ, যার নাম ‘ভারতের চিঠি --- পার্ল বাককে’। বিশ্বসাহিত্য অঙ্গন সম্পর্কে তিনি কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
তিনি সর্বসাকুল্যে তিনটি উপন্যাস লিখেছিলেন। ‘রাঙ্গামাটি', ‘শাদা হাওয়া' এবং ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এদের মধ্যে, ‘রাঙ্গামাটি' তাঁর লেখা উপন্যাস কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক আছে।
সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, কেউ দশটি উপন্যাস লিখেও সাহিত্যিকদের তালিকায় স্থান পান না, আবার কেউ একটি উপন্যাস লিখেই তালিকার শীর্ষে স্থান করে নেন। কথাটি অদ্বৈত মল্লবর্মনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতেই পারে, কারণ মূলত সাহিত্যের জগতে তাঁর যা কিছু খ্যাতি, তা তাঁর একটিমাত্র উপন্যাসের জন্য। উপন্যাসটির নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম'।
বাংলা সাহিত্যে কিন্তু নদীকেন্দ্রিক অনেক বিখ্যাত উপন্যাস আছে। যেমন ধরুন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি', সমরেশ বসুর 'গঙ্গা', সরোজ কুমার রায়চৌধুরীর 'ময়ূরাক্ষী', বোধিসত্ত্ব মৈত্রের 'ঝিনুকের পেটে মুক্ত', আব্দুল জব্বারের 'ইলিশমারির চর', দেবেশ রায়ের 'তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্তত' প্রভৃতি উপন্যাস। কিন্তু তিতাস একটি নদীর নাম এই উপন্যাসটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী। আমি বলতে চাইছি, 'পদ্মা নদীর মাঝি' উপন্যাসের জীবনের সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বা 'গঙ্গা' নদীর উপন্যাসের জীবনের সঙ্গে সমরেশ বসুর যে দূরত্ব ছিল, অদ্বৈত মল্লবর্মনের ক্ষেত্রে কিন্তু সেই দূরত্ব ছিল না। অন্যরা যেখানে নদীকেন্দ্রিক জীবনপ্রণালীকে পর্যবেক্ষণ করে উপাদান আহরণ করেছেন, সেখানে অদ্বৈত মল্লবর্মণ কিন্তু তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাই উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন, কারণ তিনি ছিলেন মালোপাড়ার বাসিন্দা, জেলেদের ঘরের সন্তান, সুতরাং তিতাস নদীর পারে যে জীবনপ্রণালী, তিনি নিজেই ছিলেন সেই জীবনপ্রণালীতে অঙ্গীভূত।
সেজন্যে যখন, কোন একজন তাঁকে বলেছিলেন, 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন 'পদ্মা নদীর মাঝি', আর কি তোমার বই মানুষ নেবে?'
উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন, তাতে বাস্তব জীবনে অবগাহন করা প্রান্ত-বর্গীয় এক মানুষের কন্ঠই ধ্বনিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন:
'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় artist, master artist, কিন্তু বাওনের পো! রোমান্টিক। আর আমি তো জাউলার পোলা।'
উপন্যাসে দেখা যায় নদী আর মানুষকে জড়িয়ে মহাকাব্যিক এক অসাধারণ কাহিনী। প্রথম পর্ব থেকেই যে বন্ধন জল আর মানুষকে জড়িয়ে রেখেছিল, সেই বন্ধন বিবর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। দুকুল ছাপানো নদী তিতাস, তার জল এক সময় ফুরিয়ে আসে। মালোদের অফুরন্ত চাহিদা মেটাতে গিয়ে তিতাস যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মালোপাড়ার গৃহসুখে টান পড়ে, মাছের সন্ধানে যেতে হয় দূরদূরান্ত। মালোদের সান্ধ্যকালীন গানে কন্ঠ কমে আসে। রাতের বিছানায় টান পড়ে মানুষের।
তবুও মালোজীবনের আঁধার কাটে না। একদিন জালের খুঁটিতে নদীচরের উত্থান ধরা পড়ে। মাঝনদীর সেই চরা তিতাসকে দুটি শীর্ণ জলরেখায় বিভক্ত করে, আর সেই চরের জমির দখল নিয়ে শুরু হয় মহাজনী চাষী আর জেলেদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব। অবশেষে শোষকের বাহুবলে জমির দখল নেয় মহাজনী মালিকরা, অন্যদিকে জলজীবী নদীজীবী মালোরা জলের বাষ্পের মত একসময় বিলীন হয়ে যায়।
উপন্যাসের একেবারে শেষ পর্বে দেখা যায়, তিতাস নদীর পাড়ে সেই মালোপাড়া আর নেই। সেখানে শূন্য ভিটেতে গাছ-গাছড়া আর তাতে বাতাসের শুধু শো শো শব্দ। তিতাস নদী তখন যেন কালপ্রবাহের মতই নির্মম নিরপেক্ষ এবং উদাসীন।
ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন, ‘নদীর একটি দার্শনিক রূপ আছে। নদী বহিয়া চলে, কালও বহিয়া চলে।‘
তা, তিতাস নদীর জীবন দর্শনের উপর ভিত্তি করে, গ্রামীণ ব্রাত্যজনদের জীবনবৃত্তকে অবলম্বন করেই অদ্বৈত মল্লবর্মনের এই অসাধারণ মহাকাব্যিক উপন্যাস ---- আমাদের মনে করিয়ে দেয় বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক আর্নেষ্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি' উপন্যাসের কথা অথবা মনে করিয়ে দেয় বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক মিখাইল শলোখভের 'অ্যান্ড কোয়াইট ফ্লোজ দ্য ডন' উপন্যাসটির কথা।
আমাদের মনে রাখা দরকার, ১৯৪৫ সালে মাসিক 'মোহাম্মদী' পত্রিকায় উপন্যাসটির একটি খসড়া প্রথম প্রকাশিত হয়। সাতটি কিস্তি প্রকাশিত হওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়।
অদ্বৈত মল্লবর্মনের মৃত্যুর পর 1956 সালে পুঁথিঘর প্রকাশনা থেকে উপন্যাসটি সম্পূর্ণ আকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটিতে রয়েছে চারটি খন্ড, প্রতিটি খন্ডে দুটি করে পর্ব। প্রথম খন্ডের পর্ব দুটির নাম: 'তিতাস একটি নদীর নাম' ও 'প্রবাস খন্ড'। দ্বিতীয় খণ্ডের পর্ব দুটি হলো 'নয়া বসত' ও 'জন্ম মৃত্যু বিবাহ'। তৃতীয় খন্ডের পর্ব দুটি হল 'রামধনু' ও 'রাঙা নাও' এবং চতুর্থ খন্ডের পর্ব দুটি হল 'প্রজাপতি' ও 'ভাসমান'।
উপন্যাসটি পড়ে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন নাট্যকার নাট্যপরিচালক অভিনেতা উৎপল দত্ত। উপন্যাসটিকে তিনি মঞ্চরূপ দিতে আগ্রহী হয়েছিলেন। তাঁরই পরিচালনায় ১৯৬৩ সালের ১০ই মার্চ দোলপূর্ণিমার দিন মিনার্ভা থিয়েটারে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হলো। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে সেটি ছিল এক অবিস্মরণীয় সংযোজন।
১৯৭৩ সালে কিংবদন্তি পরিচালক হৃত্বিক ঘটকের পরিচালনায় উপন্যাসটি 'তিতাস একটি নদীর নাম'------ এই নামেই চলচ্চিত্রায়িত হয়। সেটা ছিল সর্বত্র সাড়া জাগানো এক ধ্রুপদী বাংলা ছবি।
বলাবাহুল্য, নাটক এবং চলচ্চিত্র হিসাবে তিতাস একটি নদীর নাম আজও সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে একটি মাইলস্টোন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
১৯৯২ সালে উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ 'A River called Titas' প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেছেন কল্পনা বর্ধন।
সাগরময় ঘোষ বলেছেন, অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী, তবে তাঁর শরীর ছিল শীর্ণ। ধুতির উপর ফুল শার্ট পড়তেন। পাঞ্জাবি গায়ে তাঁকে কখনো দেখা যায়নি। বিমল মিত্র তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, তাঁকে দেখে মনে হতো তিনি যেন সবসময় নিজেকে নিয়ে বিব্রত কিংবা নিজের দুর্ভাগ্যকে নিয়ে বিড়ম্বিত।
বিকেলের দিকে দেশ পত্রিকার অফিসে সাহিত্যিকরা যখন হাজির হতেন, তখন তিনি সেখানে থাকতেন না। তিনি বরাবর ছিলেন প্রচার বিমুখ। নীরবে নিঃশব্দে পত্রিকার কাজ শেষ করে তিনি চলে যেতেন নারকেলডাঙ্গার ষষ্ঠীতলা রোডের এক তিনতলা বাড়ির চিলেকোঠায়। সেখানেই ছিল তাঁর আস্তানা। শুনলে অবাক হবেন যে, আস্তানা ছিল বটে কিন্তু সেখানে শোওয়ার জন্য, ঘুমোবার জন্যে প্রায় কোন জায়গাই ছিল না। চতুর্দিক জুড়ে ছিল অজস্র বই আর বই। হ্যাঁ, অসম্ভব বই পড়তে ভালোবাসতেন, বিশাল ছিল তাঁর পাঠাভ্যাস। বই কেনা ছিল তাঁর প্যাশন। জীবনীকাররা বলেন, তিনি লেখালেখি করে উপার্জন করতেন বটে, কিন্তু তিনি ছিলেন দরিদ্র। তাঁর এই দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ ছিল বই কেনা। বই কিনতে কিনতে দরিদ্র হয়ে পড়েন – এমন অসাধারণ বইপাগল মানুষের কথা সত্যিই ভাবা যায় না।
আপনার হয়তো জানেন, তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৫২ সালের ২৬ শে এপ্রিলে তাঁর সেই বিপুল বইরাশি সাগরময় ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নরেন্দ্র নাথ মিত্র, প্রমথনাথ বিশী, সুবোধ চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিদের সহায়তায় রামমোহন লাইব্রেরীতে আনুষ্ঠানিকভাবে অর্পণ করা হয়।
তবে তাঁর দারিদ্র্যের আরেকটি কারণও ছিল। যা তিনি উপার্জন করতেন, তার সিংহভাগ ব্যয় করতেন উদ্বাস্তু স্বজাতীয় মালোদের জন্য। সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, চারিদিক জুড়ে দাঙ্গা, আর সেই সংকটপূর্ণ সময়ে গ্রাম থেকে, তিতাস নদীর পাড় থেকে, পূর্ব বাংলা থেকে কলকাতা শহরের বুকে দলে দলে এসে ঠাই নিয়েছিল উদ্বাস্তু মানুষজন। তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ বই কেনার পাশাপাশি বাকি প্রায় সব টাকাই বিলিয়ে দিতেন সেই উদ্বাস্তুদের মধ্যে।
উদ্বাস্তুদের সাহায্য করা আর বই কেনা ---এই দুইয়ের অভিঘাতে তিনি ক্রমশ হয়ে পড়েছিলেন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর, আর শোচনীয় ভাবে আক্রান্ত হলেন অপুষ্টি জনিত যক্ষারোগে। ভর্তি করা হলো কাঁচরাপাড়ার যক্ষ্মা হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালের জীবনকে তিনি মেনে নিতে পারলেন না। উদ্বাস্তু মালোদের জন্য তিনি চঞ্চল হয়ে উঠলেন। অবশেষে একদিন হাসপাতাল থেকে তিনি পালিয়ে এসে আবার উপস্থিত হলেন নারকেলডাঙ্গার ষষ্ঠীতলা রোডের সেই তিনতলা বাড়ির চিলেকোঠায়। শুরু হলো আবার লেখালেখি আর উদ্বাস্তুদের সাহায্য করা। কিন্তু এভাবে আর বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারলেন না। ঘন ঘন জ্বরে ভুগতেন, শরীর ক্রমশ শীর্ণ হয়ে আসছিল। অবশেষে অপুষ্টি অর্ধাহার আর অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য ১৯৫১ সালের ১৬ই এপ্রিল মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তাঁর জীবনের আলোকশিখা চিরতরে নিভে গেল।
তাঁর প্রয়ানের সংবাদ শুনে সাহিত্যিক বিমল মিত্র লিখেছিলেন:
“অনেক আর্থিক দুর্গতি আর অনুগত গলগ্রহদের বোঝা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। .... অদ্বৈতবাবু হয়তো গেলেন, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের একটি অক্ষয় সাক্ষর রেখে গেলেন তাঁর ‘তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে।"
সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেন:
“এমন এক সাহিত্যপ্রতিভা এরূপ অকাল অপমৃত্যু বরণ করতে বাধ্য হল, এটা আমাদের সমাজব্যবস্থার দুরপনেয় কলঙ্ক।“
বসুধা চক্রবর্তী লিখেছেন:
“ধনতান্ত্রিক সমাজ তাঁকে তিলে তিলে একান্ত অকালে, অসময়ে জীবনের বিরাট প্রতিশ্রুতি অসম্পূর্ণ রেখে হত্যা করেছে।“
দেশ পত্রিকায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে লেখা হলো:
“খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার বাজারে তরুন বাণীসাধক অদ্বৈত মল্লবর্মণ হয়তো আর পাঁচজন শ্রুতকীর্তির মত সফলতা লাভ করেন নাই। কিন্তু জীবনের যে-ক্ষেত্রে তিনি সফলতা লাভ করিয়াছিলেন, সে ক্ষেত্রে তিনি বহু কীর্তিমান ও খ্যাতিমানের তুলনায় অগ্রণী। ..... কাহাকেও বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন না করিয়া, কোন মানুষকে বিপন্ন না করিয়া, কাহারো কোনো ক্ষতি না করিয়া জীবনযাপনের এক দুরূহ ব্রতে তিনি যে সফলতা লাভ করিয়াছিলেন, তাহা আজকের যুগে বিরল।“
বাস্তবিকই পৃথিবীতে এমন মানুষও দেখা যায়, যাঁরা নিজেদের কীর্তির ও কৃতিত্বের তুলনায় অনেক বেশি মহৎ। অদ্বৈত মল্লবর্মণ নি:সন্দেহে সেরকমই এক মহৎ সাহিত্যিক।
Adwaita Mallabarman Life Story (অদ্বৈত মল্লবর্মণ এক অসামান্য জীবন কাহিনী) --- এই রচনাটি ভিডিওতে দেখতে নিচের ভিডিওতে ক্লিক করুন:
....................................................................
তথ্যঋণ:
১) অদ্বৈত মল্লবর্মণ By নিতাই বসু
২) অদ্বৈত মল্লবর্মণ: স্রষ্টা ও সৃষ্টি Edited By মিলনকান্তি বিশ্বাস
৩) সম্পাদকের বৈঠকে By সাগরময় ঘোষ
৪) উইকিপিডিয়া
Comments
Post a Comment