সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : প্রথম চুম্বন, মদ্যপান আর প্রেমের গল্প / Sunil Gangopadhyay : Story of First Kiss, Wine and Love
৩. প্রথম চুম্বন
শৈশবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্যিক বিমল চন্দ্র ঘোষ তথা মৌমাছিরসংস্থা মনিমালার সদস্য ছিলেন। সেবার পাড়ায় মনিমালার উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল সরস্বতী পূজো।সেদিন কিন্তু কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা কিনে ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে মন্ডপে নিয়ে আসতে আসতে বেজে গেল রাত নটা।এরপর প্রতিমাকে বেদীতে বসাতে হবে, ডাকের সাজ পড়াতে হবে,মন্ডপ সাজাতে হবে, অনেক কাজবাকি। সবই সেরে ফেলতে হবে রাতের মধ্যে, কারণ সকালেই তো পুজো
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে নাকে মুখে কিছু খাবার গুঁজে, বাইরে রাত কাটানোর অনুমতি আদায় করে ছুটে এসেছেন পূজামণ্ডপে। তিন-চার জন বন্ধু মিলে শুরু হলো কাজ। প্রায় মাঝরাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে আসতে বন্ধুরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে একা পাহারায় বসিয়ে বাড়ি চলে গেলে।
নিঃশব্দ নিবিড় সেই রাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একাকী বসে ছিলেন দীর্ঘক্ষণ। আর তার সামনে একটি মাটির প্রতিমা মূর্তি ছাড়া আর কিছু ছিলনা। সেরাতে দীর্ঘসময় প্রতিমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একসময় তার সর্বাঙ্গে অদ্ভুত অবর্ণনীয় একটা রোমাঞ্চকর শিহরণ খেলে গেল। তার মনে হলো, অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রীর প্রতিমা যেন এক নারী, পরিপূর্ণ এক নারী। অল্প অল্প শীতে আচমকা উষ্ণ হয়ে উঠলো তার শরীর। এক অবর্ণনীয় ঘোরের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি উঠে এলেন প্রতিমার কাছে। মাটির সেই মূর্তিকে তিনি স্পর্শ করলেন। আচমকা জেগে ওঠা এক অপ্রতিরোধ্য আবেগে তিনি প্রতিমার ওষ্ঠ চুম্বন করলেন।
এই চুম্বনই ছিল তার জীবনের প্রথম চুম্বন।
তিনি লিখেছেন, “পরের দিন সেই উচ্ছিষ্ট মূর্তির পুজো হলো। কেউ কিছু জানতেও পারেনি, কোন অঘটনও ঘটেনি।“
২. প্রথম মদ্যপান
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিমান মল্লিক। সেই বন্ধুর সাথে একদিন লাইটহাউসে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। লাইট হাউসের দোতালায় বেশ সাজানো গোছানো একটা রেস্টুরেন্ট কাম বার ছিল। সিনেমা শুরু হওয়ার আগেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সেই বন্ধু, বিমান মল্লিক নিয়ে গেলেন বারের ভেতর। লম্বা এক বেয়ারাকে খাবারের অর্ডার দিয়েই বিমান নিচু গলায় বললেন, সুনীল একটু মদ খাবে নাকি?
মদ খাওয়া নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছুৎমার্গ ছিল, কিন্তু সেসময় অনেকটাই তা অপসৃত। ভাবলেন, একবার চেখে দেখলে মন্দ কি?
লম্বা সেই বেয়ারাকে ডেকে বিমান মল্লিক ফিসফিস করে বললেন, আমাদের এমন কোনো মদ দিতে পারেন,যাতে মুখে গন্ধ পাওয়া যাবে না?
বেয়াড়া মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই দুটি সুদৃশ্য কাঁচের গ্লাসে উপস্থিত হল রোমাঞ্চকর সেই পানীয়। সতর্কভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে দুজনে একসাথে চুমুক দিলেন। তারপরই তাদের মুখে উদ্ভাসিত হয়ে গেল এক দিব্য আনন্দ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভাবলেন, এর নাম মদ? এত অপূর্ব সুস্বাদু? তবে লোকে এর এতো বদনাম করে কেন?
আসল গল্পটা এরপরেই। বেশ কয়েক বছর পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লন্ডনে গিয়েছিলেন আর সেই শহরে দেখা হল বন্ধুবর বিমান মল্লিকের সাথে। তিনি সহাস্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বললেন, “সুনীল তোমার মনে আছে,লাইটহাউসের সেই রেস্টুরেন্টে আমাদের প্রথম মদ খাওয়ার গল্প? সেদিন লম্বা সেই বেয়াড়া আমাদের কি ঠকনোই না ঠকিয়েছিল? দাম নিয়েছিল মদের, কিন্তু এক ফোঁটাও মদ ছিল না। কাঁচের গ্লাসে ঠেকিয়ে দিয়েছিল স্রেফ শরবত।"
এর বেশ কয়েক বছর পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম মদ্যপান করেছিলেন বন্ধু বুড্ঢার সাথে।বুড্ঢার আসল নাম ছিল সুনন্দ গুহঠাকুরতা। তিনি ছিলেন রুপবান,গুণবান এবং ধনী পরিবারের সন্তান।
একদিন সেই বন্ধুটি সুনীলসহ আরো কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ঢুকলেন গ্র্যান্ড হোটেলে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ছিল সেটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সেই প্রথম তিনি গ্র্যান্ড হোটেলে পা দিয়েছেন। গ্র্যান্ড হোটেলে যে তাঁর মত সাধারণ মানুষেরও প্রবেশ অধিকার ছিল, তা তিনি জানতেনই না।হোটেলে চারিদিকে সাহেব মেম আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ভীড়। বুড্ঢার সৌজন্যে তাঁরা গিয়ে বসলেন বার কাউন্টারের উঁচু টুলগুলিতে। একদম ইংরেজি সিনেমার মতো।
কাঁচের গ্লাসে সোডা মেশানো হুইস্কি আসতেই চোখ বন্ধ করে চুমুক দিলেন। সঙ্গে ছিল কাজুবাদাম আর কাবাব জাতীয় কিছু।চার-চারটে পেগের পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বুঝলেন যে, তাঁর নেশা হয়নি। আরও চাই। বুড্ডা তখন কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, "আমি ভেবেছিলাম, তোরা বেশি খেতে পারবি না। তাই খুব বেশি টাকা আনি নি। এবার তুই বলবি, তুই আর পারছিস না।"
সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় কারো পা টলমল হল না। নেশাটেশা কারও কিচ্ছু মালুমই হল না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মনে মনে বললেন, “লাইট হাউস তো সেদিন ঠকিয়েদিয়েছিল,গ্র্যান্ডহোটেলেও কি জল মিশিয়ে মানুষ ঠকায় নাকি? এ তো অবিশ্বাস্য!“
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মদ্যপানের আসল দীক্ষাগুরু ছিলেন ক্রিটিক্যাল রাইটার কমলকুমার মজুমদার যিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে গিয়েছিলেন খালাসিটোলায়। টিনের চালের পাতি শুঁড়িখানায়। সেখানে বাংলা মদের ডাকনাম ছিল মা কালী। অনেকে ইংরেজিতে নামটা বিকৃত করে বলতেন, "ওটা মাকালী নয়, মেকলে মেকলে।" অবশ্য কয়েক বছর পর উত্তমকুমারের দৌলতে তার নাম দাঁড়ায় "অমানুষ"।
তা, সেই শুঁড়িখানাতেই কমলকুমার মজুমদারের হাত ধরেই চোর-গুন্ডা-পকেটমারের সাথে, মুচি-মেথর-জনমান্দারদের সাথে, কেরানি-কবি-সাহিত্যিকদের সাথে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ধরেছিলেন কলকাতার সবচেয়ে সস্তা দেশী মদ। সঙ্গে থাকত ছোট্ট প্লাস্টিকের থালায় কিছুটা আদা ও কয়েকটি ছোলা।সেই পাকাপাকিভাবে শুরু, পরবর্তীকালে সে নেশার রূপবদল হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা আমৃত্যু কখনো সঙ্গী হয়নি।
১. প্রথম প্রেম
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল জাহাজের খালাসি হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো। কখনোই তাঁর কবি বা লেখকের হওয়ার ইচ্ছে ছিল না বিন্দুমাত্র। কিন্তু জীবনের প্রথম প্রেমই তার জীবনকে ঘুরিয়ে দিল সম্পূর্ণ অন্যখাতে।
ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে যে মেয়েটির প্রেমে তিনি পড়েছিলেন, তাঁর নাম, তিনি দিয়েছেন, অপর্ণা। অপর্ণা এক বছরের ছোট, থাকতেন বিডন স্ট্রিটে। রবীন্দ্র কবিতার অসম্ভব অনুরাগী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে কথায় কথায় বা চিঠিতে চিঠিতে অপর্ণা সব সময় রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করতেন। আর তাঁর মন পাওয়ার জন্যই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়া শুরু করলেন। প্রেমের পাল্লায় পড়ে কবিগুরুর সঞ্চয়িতা বইয়ের বহু কবিতা একেবারে। ঠোটস্থ করে ফেলেছিলেন।
অপর্ণার পড়ার টেবিলে দেশ পত্রিকা দেখেছিলেন সুনীল। তখন দেশ পত্রিকায় স্বল্প জায়গা জুড়ে কবিতা ছাপানো হত। তা, অপর্ণাকে কাছে পাবার নেশায়, তাঁকে মোহিত করার লক্ষ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রাতারাতি লিখেও ফেললেন কয়েকটি কবিতা। সেই প্রথম কবিতা লেখা শুরু। পাঠিয়েও দিলেন দেশ পত্রিকার ঠিকানায়।১৯৫২সালের ২৯শে মার্চের সংখ্যায় দেশ পত্রিকায় আচমকা প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম কবিতা : "একটি চিঠি"। বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর।
তা,বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন, সকলের অগোচরে এক মহাগোপনীয়তায় অপর্ণার সাথে তাঁর প্রণয় পর্ব চলেছিল দীর্ঘদিন। শুনলে হতবাক হয়ে যাবেন, এই প্রেম-সম্পর্কের দরুনই একদিন অপর্ণার বাড়ির কাছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পাড়ার ছেলেদের হাতে বেধড়ক উত্তম-মধ্যমও খেয়েছিলেন।বেপাড়ার ছেলে হয়ে তিনি পাড়ার মেয়েদের সাথে প্রেম করবেন, এটা সেই ছেলেরা মেনে নিতে পারেনি কখনোই।
গঙ্গার ধারে সান্ধ্যকালীন এক নির্জনতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে অপর্ণা একদিন বলেছিলেন, সামনেই তাঁর বিয়ে।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিয়েতে নিমন্ত্রিত হবেনই। কিন্তু বিয়েতে যেন সুনীল যেন কখনোই না যান।
সেদিন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনো বিশ্বাসই করতে পারেন নি যে, তাঁর জীবন থেকে অপর্ণা পাকাপাকিভাবে অনেক দূরে সরে যাচ্ছেন,চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছেন।
বিচ্ছেদের সেই শূন্যতা তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল আজীবন।
বাঙালি পাঠক মাত্রই জানেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনবদ্য অসামান্য এক সৃষ্টি, নীরা। সুনীলের জন্য নীরা, নাকি নীরার জন্য সুনীল--- কোনটি যে সত্য, তা নিয়ে আজও বাঙালির ঘোর কাটেনি।
কে জানে , নীরা হয়তো বা প্রথম প্রেম,সেই অপর্ণারই ছায়া।
তথ্যসূত্র:
১) অর্ধেক জীবন By সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২) গুগল নেটওয়ার্ক
(প্রতিবেদনটি ভিডিওতে দেখতে এই বাক্যের উপর ক্লিক করুন) ............................................................
লেখা: ০৭/০৯/২০২০
শৈশবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্যিক বিমল চন্দ্র ঘোষ তথা মৌমাছিরসংস্থা মনিমালার সদস্য ছিলেন। সেবার পাড়ায় মনিমালার উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল সরস্বতী পূজো।সেদিন কিন্তু কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা কিনে ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে মন্ডপে নিয়ে আসতে আসতে বেজে গেল রাত নটা।এরপর প্রতিমাকে বেদীতে বসাতে হবে, ডাকের সাজ পড়াতে হবে,মন্ডপ সাজাতে হবে, অনেক কাজবাকি। সবই সেরে ফেলতে হবে রাতের মধ্যে, কারণ সকালেই তো পুজো
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে নাকে মুখে কিছু খাবার গুঁজে, বাইরে রাত কাটানোর অনুমতি আদায় করে ছুটে এসেছেন পূজামণ্ডপে। তিন-চার জন বন্ধু মিলে শুরু হলো কাজ। প্রায় মাঝরাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে আসতে বন্ধুরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে একা পাহারায় বসিয়ে বাড়ি চলে গেলে।
নিঃশব্দ নিবিড় সেই রাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একাকী বসে ছিলেন দীর্ঘক্ষণ। আর তার সামনে একটি মাটির প্রতিমা মূর্তি ছাড়া আর কিছু ছিলনা। সেরাতে দীর্ঘসময় প্রতিমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একসময় তার সর্বাঙ্গে অদ্ভুত অবর্ণনীয় একটা রোমাঞ্চকর শিহরণ খেলে গেল। তার মনে হলো, অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রীর প্রতিমা যেন এক নারী, পরিপূর্ণ এক নারী। অল্প অল্প শীতে আচমকা উষ্ণ হয়ে উঠলো তার শরীর। এক অবর্ণনীয় ঘোরের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি উঠে এলেন প্রতিমার কাছে। মাটির সেই মূর্তিকে তিনি স্পর্শ করলেন। আচমকা জেগে ওঠা এক অপ্রতিরোধ্য আবেগে তিনি প্রতিমার ওষ্ঠ চুম্বন করলেন।
এই চুম্বনই ছিল তার জীবনের প্রথম চুম্বন।
তিনি লিখেছেন, “পরের দিন সেই উচ্ছিষ্ট মূর্তির পুজো হলো। কেউ কিছু জানতেও পারেনি, কোন অঘটনও ঘটেনি।“
২. প্রথম মদ্যপান
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিমান মল্লিক। সেই বন্ধুর সাথে একদিন লাইটহাউসে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। লাইট হাউসের দোতালায় বেশ সাজানো গোছানো একটা রেস্টুরেন্ট কাম বার ছিল। সিনেমা শুরু হওয়ার আগেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সেই বন্ধু, বিমান মল্লিক নিয়ে গেলেন বারের ভেতর। লম্বা এক বেয়ারাকে খাবারের অর্ডার দিয়েই বিমান নিচু গলায় বললেন, সুনীল একটু মদ খাবে নাকি?
মদ খাওয়া নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছুৎমার্গ ছিল, কিন্তু সেসময় অনেকটাই তা অপসৃত। ভাবলেন, একবার চেখে দেখলে মন্দ কি?
লম্বা সেই বেয়ারাকে ডেকে বিমান মল্লিক ফিসফিস করে বললেন, আমাদের এমন কোনো মদ দিতে পারেন,যাতে মুখে গন্ধ পাওয়া যাবে না?
বেয়াড়া মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই দুটি সুদৃশ্য কাঁচের গ্লাসে উপস্থিত হল রোমাঞ্চকর সেই পানীয়। সতর্কভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে দুজনে একসাথে চুমুক দিলেন। তারপরই তাদের মুখে উদ্ভাসিত হয়ে গেল এক দিব্য আনন্দ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভাবলেন, এর নাম মদ? এত অপূর্ব সুস্বাদু? তবে লোকে এর এতো বদনাম করে কেন?
আসল গল্পটা এরপরেই। বেশ কয়েক বছর পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লন্ডনে গিয়েছিলেন আর সেই শহরে দেখা হল বন্ধুবর বিমান মল্লিকের সাথে। তিনি সহাস্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বললেন, “সুনীল তোমার মনে আছে,লাইটহাউসের সেই রেস্টুরেন্টে আমাদের প্রথম মদ খাওয়ার গল্প? সেদিন লম্বা সেই বেয়াড়া আমাদের কি ঠকনোই না ঠকিয়েছিল? দাম নিয়েছিল মদের, কিন্তু এক ফোঁটাও মদ ছিল না। কাঁচের গ্লাসে ঠেকিয়ে দিয়েছিল স্রেফ শরবত।"
এর বেশ কয়েক বছর পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম মদ্যপান করেছিলেন বন্ধু বুড্ঢার সাথে।বুড্ঢার আসল নাম ছিল সুনন্দ গুহঠাকুরতা। তিনি ছিলেন রুপবান,গুণবান এবং ধনী পরিবারের সন্তান।
একদিন সেই বন্ধুটি সুনীলসহ আরো কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ঢুকলেন গ্র্যান্ড হোটেলে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ছিল সেটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সেই প্রথম তিনি গ্র্যান্ড হোটেলে পা দিয়েছেন। গ্র্যান্ড হোটেলে যে তাঁর মত সাধারণ মানুষেরও প্রবেশ অধিকার ছিল, তা তিনি জানতেনই না।হোটেলে চারিদিকে সাহেব মেম আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ভীড়। বুড্ঢার সৌজন্যে তাঁরা গিয়ে বসলেন বার কাউন্টারের উঁচু টুলগুলিতে। একদম ইংরেজি সিনেমার মতো।
কাঁচের গ্লাসে সোডা মেশানো হুইস্কি আসতেই চোখ বন্ধ করে চুমুক দিলেন। সঙ্গে ছিল কাজুবাদাম আর কাবাব জাতীয় কিছু।চার-চারটে পেগের পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বুঝলেন যে, তাঁর নেশা হয়নি। আরও চাই। বুড্ডা তখন কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, "আমি ভেবেছিলাম, তোরা বেশি খেতে পারবি না। তাই খুব বেশি টাকা আনি নি। এবার তুই বলবি, তুই আর পারছিস না।"
সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় কারো পা টলমল হল না। নেশাটেশা কারও কিচ্ছু মালুমই হল না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মনে মনে বললেন, “লাইট হাউস তো সেদিন ঠকিয়েদিয়েছিল,গ্র্যান্ডহোটেলেও কি জল মিশিয়ে মানুষ ঠকায় নাকি? এ তো অবিশ্বাস্য!“
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মদ্যপানের আসল দীক্ষাগুরু ছিলেন ক্রিটিক্যাল রাইটার কমলকুমার মজুমদার যিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে গিয়েছিলেন খালাসিটোলায়। টিনের চালের পাতি শুঁড়িখানায়। সেখানে বাংলা মদের ডাকনাম ছিল মা কালী। অনেকে ইংরেজিতে নামটা বিকৃত করে বলতেন, "ওটা মাকালী নয়, মেকলে মেকলে।" অবশ্য কয়েক বছর পর উত্তমকুমারের দৌলতে তার নাম দাঁড়ায় "অমানুষ"।
তা, সেই শুঁড়িখানাতেই কমলকুমার মজুমদারের হাত ধরেই চোর-গুন্ডা-পকেটমারের সাথে, মুচি-মেথর-জনমান্দারদের সাথে, কেরানি-কবি-সাহিত্যিকদের সাথে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ধরেছিলেন কলকাতার সবচেয়ে সস্তা দেশী মদ। সঙ্গে থাকত ছোট্ট প্লাস্টিকের থালায় কিছুটা আদা ও কয়েকটি ছোলা।সেই পাকাপাকিভাবে শুরু, পরবর্তীকালে সে নেশার রূপবদল হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা আমৃত্যু কখনো সঙ্গী হয়নি।
১. প্রথম প্রেম
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল জাহাজের খালাসি হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো। কখনোই তাঁর কবি বা লেখকের হওয়ার ইচ্ছে ছিল না বিন্দুমাত্র। কিন্তু জীবনের প্রথম প্রেমই তার জীবনকে ঘুরিয়ে দিল সম্পূর্ণ অন্যখাতে।
ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে যে মেয়েটির প্রেমে তিনি পড়েছিলেন, তাঁর নাম, তিনি দিয়েছেন, অপর্ণা। অপর্ণা এক বছরের ছোট, থাকতেন বিডন স্ট্রিটে। রবীন্দ্র কবিতার অসম্ভব অনুরাগী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে কথায় কথায় বা চিঠিতে চিঠিতে অপর্ণা সব সময় রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করতেন। আর তাঁর মন পাওয়ার জন্যই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়া শুরু করলেন। প্রেমের পাল্লায় পড়ে কবিগুরুর সঞ্চয়িতা বইয়ের বহু কবিতা একেবারে। ঠোটস্থ করে ফেলেছিলেন।
অপর্ণার পড়ার টেবিলে দেশ পত্রিকা দেখেছিলেন সুনীল। তখন দেশ পত্রিকায় স্বল্প জায়গা জুড়ে কবিতা ছাপানো হত। তা, অপর্ণাকে কাছে পাবার নেশায়, তাঁকে মোহিত করার লক্ষ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রাতারাতি লিখেও ফেললেন কয়েকটি কবিতা। সেই প্রথম কবিতা লেখা শুরু। পাঠিয়েও দিলেন দেশ পত্রিকার ঠিকানায়।১৯৫২সালের ২৯শে মার্চের সংখ্যায় দেশ পত্রিকায় আচমকা প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম কবিতা : "একটি চিঠি"। বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর।
তা,বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন, সকলের অগোচরে এক মহাগোপনীয়তায় অপর্ণার সাথে তাঁর প্রণয় পর্ব চলেছিল দীর্ঘদিন। শুনলে হতবাক হয়ে যাবেন, এই প্রেম-সম্পর্কের দরুনই একদিন অপর্ণার বাড়ির কাছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পাড়ার ছেলেদের হাতে বেধড়ক উত্তম-মধ্যমও খেয়েছিলেন।বেপাড়ার ছেলে হয়ে তিনি পাড়ার মেয়েদের সাথে প্রেম করবেন, এটা সেই ছেলেরা মেনে নিতে পারেনি কখনোই।
গঙ্গার ধারে সান্ধ্যকালীন এক নির্জনতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে অপর্ণা একদিন বলেছিলেন, সামনেই তাঁর বিয়ে।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিয়েতে নিমন্ত্রিত হবেনই। কিন্তু বিয়েতে যেন সুনীল যেন কখনোই না যান।
সেদিন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনো বিশ্বাসই করতে পারেন নি যে, তাঁর জীবন থেকে অপর্ণা পাকাপাকিভাবে অনেক দূরে সরে যাচ্ছেন,চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছেন।
বিচ্ছেদের সেই শূন্যতা তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল আজীবন।
বাঙালি পাঠক মাত্রই জানেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনবদ্য অসামান্য এক সৃষ্টি, নীরা। সুনীলের জন্য নীরা, নাকি নীরার জন্য সুনীল--- কোনটি যে সত্য, তা নিয়ে আজও বাঙালির ঘোর কাটেনি।
কে জানে , নীরা হয়তো বা প্রথম প্রেম,সেই অপর্ণারই ছায়া।
তথ্যসূত্র:
১) অর্ধেক জীবন By সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২) গুগল নেটওয়ার্ক
(প্রতিবেদনটি ভিডিওতে দেখতে এই বাক্যের উপর ক্লিক করুন) ............................................................
লেখা: ০৭/০৯/২০২০





Comments
Post a Comment