জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্যদেবী : বিয়ের গল্প / Jibanananda Das and Labanya Debi : Marriage Story

This article is about: Jibanananda Das and Labanya Debi : Marriage Story (জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্যদেবী : বিয়ের গল্প)

তখন তিনি ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী। হোস্টেলে থাকতেন, একদিন হঠাৎ বাড়ি থেকে ডাক আসলো। জ্যাঠামশাই অমৃতলাল গুপ্ত ডেকে পাঠিয়েছেন। হোস্টেল থেকে বাড়ি কিন্তু বেশি দূরে ছিল না। আসলে সেই বাড়িটি ছিল তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি। খুব ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে সেই ছাত্রীটি জ্যাঠামশাইয়ের কাছেই মানুষ।

তা, সেদিন জ্যাঠামশাইয়ের ডাক পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে তিনি বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। বৃষ্টিতে তখন রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত। শাড়ি আর জুতোয় বেশ কাদাটাদা লাগিয়ে তিনি বাড়িতে উপস্থিত হলেন।

জ্যাঠামশাই জানালেন, বাড়িতে একজন অতিথি এসেছেন। চা-জলখাবার দরকার।

তা চা আর লুচি নিয়ে ইডেন কলেজের সেই ছাত্রীটি ঘরে ঢুকে দেখলেন ২৮/২৯ বছরের একজন ভদ্রলোক ঘরে চুপ করে বসে আছেন। গায়ের রং কালো, ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত। মুহূর্তে একবার চোখাচোখি হল।

জ্যাঠামশাই বললেন, ইনি দিল্লি থেকে এসেছেন। দিল্লীর রামযস কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। নাম-- জীবনানন্দ দাশ।

তা, সেই নতুন অতিথি, তিনি কিন্তু দেখলেন, হাতে খাবারের প্লেট হাতে ঘরে উপস্থিত হয়েছেন লম্বা ছিপ ছিপে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ একটি মেয়ে। মুখটি লম্বা, চোখগুলি তীক্ষ্ণ, পাতলা ঠোঁট। বয়স ১৭ কি ১৮ হবে। আটপৌরে শাড়ির পাড়ে কাদার ছিটে লেগে রয়েছে।

মেয়েটিকে সেদিন জীবনানন্দ দাশ ধীরস্থির ভাবে তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন।

প্রথম প্রশ্ন ছিল: আপনার নাম কি?

 দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল: আইএ তে আপনি কি কি সাবজেক্ট নিয়েছেন?

 আর তৃতীয় প্রশ্ন ছিল: কোন সাবজেক্টটি আপনার সবচেয়ে বেশি পছন্দ?

কোন মতে প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন লাবণ্যদেবী। হয়তো বুঝতে আর কোন অসুবিধা হয়নি যে, ঘরে মেয়ে-দেখা পর্ব চলছিল।

সেদিন বিকেল বেলা জ্যাঠামশাই লাবণ্য দেবীকে জিজ্ঞেস করলেন, “সকালের ভদ্রলোককে তোমার কেমন লাগলো?” 

লাবণ্যদেবী পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, উনি এসেছিলেন কেন?”

উত্তরে জ্যাঠামশাই খোলাখুলি বলেছিলেন, “উনি তোমাকে দেখতে এসেছিলেন।“

 লাবণ্য দেবী পরিষ্কার জানালেন, বি এ পাস না করে তিনি বিয়ে করবেন না।

Jibanananda Das and Labanya Debi : Marriage Story (জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্যদেবী : বিয়ের গল্প) ----এই লেখাটি ভিডিওতে দেখার জন্য নিচের ইউটিউব ভিডিওতে ক্লিক করুন:


জ্যাঠামশাই বেশ চিন্তিত হয়ে বললেন, “তুমি যে বিয়ে করতে চাইছ না, আমি চোখ বুজলে তোমায় দেখবে কে? তোমার দিদির বিয়ে হয়তো শিগগিরই ঠিক হয়ে যাবে। তোমার ছোট বোনটি খুবই ছোট, তার বিয়ের কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া, উনি তো তোমাকে পড়াতে রাজি আছেন। বি এ পড়তে তোমার তো কোনো বাধা নেই। তাহলে এই বিয়েতে আপত্তি করার কি আছে?”

 লাবণ্যদেবী বুঝেছিলেন, তার মা-বাবা নেই। ছোটবেলাতেই তাদের তিনি হারিয়েছেন। দিদির বিয়েও ঠিক হচ্ছে। এরকম অবস্থায় তাঁর বিয়ে হলে জ্যাঠামশাই দায়মুক্ত হবেন। 

সুতরাং, জ্যাঠামশাইকে দায়মুক্ত করতেই বিয়েতে তিনি মত দিলেন। তবে শেষবারের মতো জ্যাঠামশাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ভদ্রলোকের মত না জেনেই আমার মত জানতে চাইছেন কেন?”

জ্যাঠামশাই হাসতে হাসতে বলছিলেন, “তিনি তো সেই সকালে তোমাকে দেখেই মত দিয়ে গেছেন।“

লাবণ্যদেবী চমকে উঠেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি শুনে এসেছেন, কত রকম ভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে মেয়েকে বরপক্ষীয় লোকজনের সামনে দাঁড়াতে হয়। তাঁরা হাজার রকমের প্রশ্ন করে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরীক্ষা করে তবেই তাঁরা মতামত দেন। অথচ তাঁর বেলা! সেরকম তো কিছুই হলো না! কোন ভীতিপ্রদ অবস্থার মুখোমুখি তাঁকে তো হতে হলো না! আশ্চর্য! তাঁর মনের মধ্যে জীবনানন্দ দাশের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জেগে উঠলো।

অবশেষে ১৯৩০ সালের ৯ই মে ঢাকার ব্রাহ্মমন্দিরে বিয়ে হল জীবনানন্দ দাশের সাথে লাবণ্যবালা গুপ্তের। বিয়ের পর লাবণ্যবালা গুপ্ত হলেন লাবণ্যবালা দাশ বা লাবণ্য দাশ।

ফুলশয্যার রাতের গল্পটি আপনারা সকলে হয়তো জানেন। ফুলশয্যার রাতে কথা হয়েছিল দুজনের।

জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, “আমি শুনেছি, তুমি গাইতে পারো। একটা গান শোনাবে?”

লাবণ্যদেবী আস্তে আস্তে বলেছিলেন, “কোন গানটি?”

--- “কোন গান? 'জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ -- গানটা যদি জানো, তবে সেটাই শোনাও।“

লাবণ্য দেবী গাইলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গান:

“জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে

বন্ধু হে আমার, রয়েছো দাঁড়ায়ে”

ফুলশয্যার সেই রাতে গানটি প্রথমবার গাইবার পর স্বামীর অনুরোধে আরো একবার গেয়েছিলেন লাবণ্য দেবী।

অনেকদিন পরে লাবণ্যদেবী একদিন হাসতে হাসতেই স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আচ্ছা, তুমি প্রথম দিনেই জীবন মরণের সীমানা ছাড়াতে চেয়েছিলে কেন?”

জীবনানন্দ দাশ হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “এই লাইন দুটির অর্থ বলতো:

'আজি এ কোন্ গান নিখিল প্লাবিয়া 

তোমার বীনা হতে আসিল নামিয়া।“

লাবণ্য দেবী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। জীবনানন্দ দাশ তখন আস্তে আস্তে বললেন, “জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এ গান গাওয়া উচিত এবং শোনা উচিত।“

তবে তাঁদের দাম্পত্য জীবনে কোথাও যেন তাল কেটেছিল। আসল বিষয় হলো, জীবনানন্দ দাশের সমগ্র জীবনজুড়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন কাব্যলক্ষ্মী। কাব্য নিয়েই ছিল তাঁর যত সাধনা। বাংলা কাব্যজগতে এক অন্যধারার কবি তিনি --- নির্জনতম কবি। যেন একাই একটি প্রতিষ্ঠান।

অন্যদিকে সহধর্মিনী লাবণ্যবালা দাশ, তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীনচেতা একজন মানুষ। কারো উপর নির্ভরশীল তিনি হতে চাননি। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে বিএ পাস করে কবির অমতেই অসুস্থ অবস্থায় তিনি বিটি পড়া শেষ করেছিলেন। শিশু বিদ্যাপীঠ নামে একটি সেকেন্ডারি স্কুলে চাকরি নিয়ে সংসারের হাল ধরেছিলেন। মেয়ে মঞ্জুশ্রী, ছেলে সমরানন্দ আর এক আত্মভোলা অন্যমনস্ক স্বামী ---- এই নিয়েই ছিল তাঁর জগতসংসার।

তিনি কখনো কাব্য চর্চা করতেন না। তাঁর জন্যে জীবনানন্দ দাশের মনে কিন্তু দুঃখ ছিল, খেদ ছিল। একদিন তো বলেই ফেলেছিলেন, “তোমার কেবল সংসার আর সংসার। তুমি কি কিছুতেই তার উপরে উঠতে পারো না? কোন দিন দেখলাম না যে তুমি কবিতার আলোচনায় মুহূর্তের জন্য যোগ দিয়েছ?”

লাবণ্য দেবী সরাসরি বলেছিলেন, “আমি কাব্যজগতের ধার ধারি না। কবিতার চাইতে সংসারকেই বেশি ভালোবাসি।"

প্রায় প্রতিদিনই বিকেলের দিকে দেশপ্রিয় পার্কের বাড়ি থেকে কবি হেঁটে যেতেন বালিগঞ্জ রেল স্টেশনে। পাখিদের কলকাকলি শুনতে শুনতে ট্রাম লাইন ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসতেন। একদিন সেভাবেই হেঁটে আসতে গিয়ে অন্যমনস্কভাবে ট্রামের ধাক্কা খেলেন। সে ধাক্কা আর তিনি সামলাতে পারেননি। ভেঙে গিয়েছিল তাঁর বুকের পাঁজর, পা আর কাঁধের হাড়। শুরু হলো শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে যমে-মানুষের অসম এক লড়াই। কবি মাত্র আট দিন বেঁচে ছিলেন। ১৯৫৪ সালের ২২ শে অক্টোবর নিভে যায় তাঁর জীবন দীপ।

“আমি ঝরে যাবো- তবু জীবন অগাধ

 তোমারে রাখিবে ধ’রে সেদিন পৃথিবীর পরে।“

কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর হাসপাতালে জড়ো হয়েছিলেন তাঁর বহু গুণমুগ্ধ বন্ধু ভক্তরা, কিন্তু সহধর্মিনী লাবণ্যদেবী হাসপাতালে যাননি। তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছিল – একথা ঠিক।

তবে সে সময় লাবণ্য দেবী কবিশিষ্য ভুমেন্দ্র গুহকে বলেছিলেন, “তোমাদের দাদা নিশ্চয়ই বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের জন্য তিনি অনেক কিছু রেখে গেলেন হয়তো। আমার জন্য কী রেখে গেলেন বলো তো?”

যাঁরা কবিকে ভালোবাসেন, তাঁরা অনেকেই লাবণ্য দেবীর সেই কথাটিকে গ্রহণ করতে পারেননি। তবে সেটি ছিল লাবণ্য দেবীর জীবনের এক অপ্রিয় সত্য।

স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু লাবণ্য দেবীকে বিপন্ন করে তুলেছিল। প্রায়ই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। হাঁপানিতে ভুগতেন, নিজের প্রতি ক্রমশ উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন। ঠিকমতো চিকিৎসা করাতেন না, ওষুধ খেতেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর লাবণ্যদেবী আরো প্রায় কুড়ি বছর বেঁচে ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৪শে এপ্রিল তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Jibanananda Das and Labanya Debi : Marriage Story (জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্যদেবী : বিয়ের গল্প) ----এই লেখাটি ভিডিওতে দেখার জন্য নিচের ইউটিউব ভিডিওতে ক্লিক করুন:


Copyright: The Galposalpo 

..........................................................................

তথ্যঋণ:

১) মানুষ জীবনানন্দ

By লাবণ্য দাশ

২) প্রিয়জনের প্রিয়তমা

By পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

৩) প্রেমের জোয়ারে

By শুভেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

৪) সাম্প্রতিক দেশকাল


Comments

Popular posts from this blog

সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য : জীবনী বা জীবন কাহিনী / Sadhak Kamalakanta Bhattacharya Life Story or Biography

অদ্বৈত মল্লবর্মণ এক অসামান্য নদীর নাম : অসামান্য জীবনী / Adwaita Mallabarman Life Story

অতুলপ্রসাদ সেন ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের গল্প / Atulprasad Sen Life Story on Forbidden Relationship