বিদ্যাসাগরের শেষ জীবন
১৮৭৫ সাল। ৩১ শে মে।
গভীর রাত..... কলকাতার আর্মহার্স্ট স্ট্রীটের ৬৩ নম্বর বাড়ির দোতলায় একটি ঘরে প্রবল অভিমানে ক্ষতবিক্ষত বিদ্যাসাগর নিজের উইল তৈরি করছেন। সেই উইলের ২৪ নম্বর যে প্যারাগ্রাফটি, তা ছিল চমকে দেওয়ার মতো। সেখানে তিনি লিখেছিলেন:
“আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুক্ত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী এজন্য, ও অন্য অন্য গুরুতর কারণবশতঃ আমি তাহার সংশ্রব ও সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছি। এই হেতু বশত... তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতুবশতঃ তিনি... ঋণ পরিশোধকালে বিদ্যমান থাকিলেও আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত অথবা... এই বিনিয়োগ পত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত হইতে পারিবেন না।’’
অর্থাৎ বিদ্যাসাগর সজ্ঞানে নিজের ছেলে নারায়ন চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে তার সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলেন। এই উইল তৈরীর পর বিদ্যাসাগর কিন্তু ১৬ বছর বেঁচে ছিলেন । আর এই সময়সীমার মধ্যে তিনি একটি শব্দও পরিবর্তন করেননি।
অথচ এই ছেলেই ছিল বিদ্যাসাগরের গর্ব।উইল তৈরি করার মাত্র ৫ বছর আগে এই ছেলেই বিদ্যাসাগরের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন ! ১৮৭০ সালে কৃষ্ণনগরের বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীকে বিয়ে করে পুত্র নারায়ণচন্দ্র বাবার বিধবা বিবাহ আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।কিন্তু তার ঠিক দু বছর পরই ১৮৭২ সালে বিদ্যাসাগর তার ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেন।
এখন প্রশ্ন হলো, কি এমন ঘটেছিল যার জন্য বিদ্যাসাগর তার ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেন, সম্পত্তি থেকে ছেলেকে বঞ্চিত করেন! এই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে এবং সেসময় বিদ্যাসাগরের জীবনের আরো কিছু চরম হতাশা জনক ঘটনা নিয়ে বিদ্যাসাগরের শেষ জীবন হয়ে উঠেছিল এক বিষাদ সাগর। ব্যতিক্রমী এক ট্রাজেডির প্রতীক।
বিদ্যাসাগর বেঁচেছিলেন ৭০বছর ১০ মাস।এর মধ্যে শেষ ৩২ বছরকে বলা হয় তাঁর অবরোহন কাল। এই অবরোহণ-কালে একের পর এক তার জীবনে ঘটেছে বন্ধুমৃত্যু, বন্ধুবিচ্ছেদ, আত্মীয়-বিচ্ছেদ, প্রিয় কন্যাদের বৈধব্য, অকল্পনীয়ভাবে প্রবল অর্থাভাব, এমন কি, যে পিতামাতার প্রতি তাঁর ভক্তি ছিল প্রবাদপ্রতিম, সেই পিতামাতার সঙ্গেও ঘটেছিল গভীর মতবিরোধ।
আর এই নৈরাশ্যের জীবন শুরু হয়েছিল ১৮৫৮ সালের নভেম্বর মাসে, যখন বিদ্যাসাগর শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তার সঙ্গে মতবিরোধের কারণে পদত্যাগ করলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে। এই ইস্তফার সাথে সাথে প্রতিপত্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের সিংহাসন থেক তাঁকে অপ্রত্যাশিতভাবে নেমে আসতে হয়েছিল।বলাবাহুল্য, শুরু হয়ে গিয়েছিল তার অবরোহন কাল।
তবে একথা সত্যি যে, পারিবারিক কলহ থেকেও তার জীবনে গভীর বিষাদ নেমে এসেছিল। বিধবা বিবাহ আন্দোলনের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর সারা জীবনে একটিই বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে বিরূদ্ধ-মত দিয়েছিলেন। তিনি কখনোই চাননি, সেই বিধবা বিবাহ হোক।
ঘটনাটি হল, বীরসিংহ গ্রামের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রাম ছিল ক্ষীরপাই। ক্ষীরপাই গ্রামের বাসিন্দা হলেন মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি ছিলেন কেঁচকাপুর স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। তিনি সেসময় মনোমোহিনী নামে একজন বিধবাকে বিয়ে করতে উদ্যোগী হন। বিয়ের জন্য তারা দুজনে বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন কাছে উপস্থিত হন। বিদ্যাসাগর কলকাতা থেকে বীরসিংহ গ্রামে এসে হলে ক্ষীরপাই গ্রামের হালদার বাবুরা বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হন। হালদারবাবুরা বিদ্যাসাগরকে কাতরভাবে জানালেন যে, মুচিরাম বন্দোপাধ্যায় হলেন তাদের ভিক্ষাপুত্র। তারা এই বিধবাবিবাহ কিছুতেই চান না। বিদ্যাসাগর যেন এই বিধবাবিবাহ রদ করে দেন।
তা, হালদার বাবুদের বারংবার অনুরোধে বিদ্যাসাগর শেষ পর্যন্ত এই বিধবাবিবাহ বন্ধ করতে রাজি হলেন। কিন্তু এরপর ঘটনা অন্যরকম ঘটলো। সেদিন রাতে বিদ্যাসাগরের সম্পূর্ণ অগোচরে বিদ্যাসাগরের ভাইরা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন এবং আরো অনেকে মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে মনমোহিনীর বিয়ে সম্পন্ন করেন। বলাবাহুল্য সেই বিধবাবিবাহতে বিদ্যাসাগরের স্ত্রী দীনময়ী দেবী এবং মা ভগবতী দেবীও সহযোগিতা করেছিলেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বিদ্যাসাগর পাশের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ শুনতে পেলেন। প্রতিবেশী গোপীনাথ সিংহকে তিনি জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন যে, তাঁর নিজের অত্যন্ত প্রিয়জনদের সাহায্যে মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবাবিবাহ রাতেই হয়ে গেছে।
বিদ্যাসাগর যে বিধবা বিয়েতে কখনই রাজি ছিলেন না, ঘটনাচক্রে বীরসিংহ গ্রামে তাঁর উপস্থিত থাকা অবস্থাতেই মা ভগবতী দেবী এবং স্ত্রী দীনময়ীর সমর্থনে ভাইয়েরা বিদ্যাসাগরকে না জানিয়ে গোপনে সেই বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
ভীষণ রাগে-ক্ষোভে বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন যে, যেহেতু প্রিয়জনদের কারণে হালদারবাবুদের কাছে তিনি তাঁর কথা রাখতে পারেননি, সেহেতু তিনি চিরকালের জন্য বীরসিংহ গ্রাম ত্যাগ করবেন।
সেদিন সকালবেলাতেই তিনি সবাইকে ডেকে জানিয়ে দেন যে , তিনি তার জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রাম চিরতরে ত্যাগ করছেন ।
কারও কোনও কথাই তিনি আর শুনলেন না। পিছনে পড়ে রইল গ্রাম, আত্মীয়-পরিজন, জননী, স্ত্রী-পুত্র, নিজের হাতে গড়া স্কুল— সব কিছু।
সব কিছু চিরদিনের
জন্য ত্যাগ করে তিনি কলকাতা যাত্রা করলেন।
সেসময় সালটা ছিল ১৮৬৯ সাল এবং বিদ্যাসাগরের বয়স ছিল ৪৯ বছর । এই ঘটনার পর প্রায় বাইশ বছর বিদ্যাসাগর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু কখনো আর বীরসিংহ গ্রামে ফিরে যান নি, এমনকি স্ত্রী দিনময়ীর মৃত্যু এবং তার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও বিদ্যাসাগর বীরসিংহ গ্রামে পা পর্যন্ত রাখেন নি।
তাঁর এই সম্পর্কচ্ছেদে ক্রোধ বা তিক্ততা যতটা ছিল, বিষাদ ও অভিমান তার চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না।
তিনি পিতা
ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতেই
লিখেছিলেন :
‘যে সকলকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা পায়, সে কাহাকেও সন্তুষ্ট করিতে পারে না, এই প্রাচীন কথা কোন ক্রমেই অযথা নহে।সংসারী লোক যে সকল ব্যক্তির কাছে দয়া ও স্নেহের আকাঙ্ক্ষা করে, তাঁহাদের একজনেরও অন্তঃকরণে যে আমার উপর দয়া ও স্নেহের লেশমাত্র নাই সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই। এরূপ অবস্থায় সাংসারিক বিষয়ে লিপ্ত থাকিয়া ক্লেশ ভোগ করা নিরবচ্ছিন্ন মূর্খতার কর্ম।’
পরম আত্মীয়-পরিজনদের ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ বিদ্যাসাগর কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন পুত্র নারায়ণ চন্দ্রের কাছ থেকে।
বিদ্যাসাগর চেয়ে ছিলেন যে তার ছেলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠুক।
তিনি কলকাতায় ছেলেকে এনে নিজের কাছে রেখে তাকে শিক্ষিত করতে চেয়ে ছিলেন।
কিন্তু সে পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় ছিল বাবা
ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তার নাতি নারায়ণচন্দ্রকে কখনোই কলকাতায় পাঠাতে চান নি।
ফলে বিদ্যাসাগরের চোখের সামনেই স্নেহান্দ্ধ ঠাকুরদার উন্মুক্ত প্রশ্রয়ে ছেলে নারায়নচন্দ্র ক্রমশ এক উচ্ছৃংখল জীবনে ডুবে গিয়েছিল। যদিও বিদ্যাসাগর একবার ছেলেকে জোর করে কলকাতায় নিয়ে এসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, তথাপি সেই ছেলে দু এক মাস কাটিয়েই পালিয়ে চলে যায় গ্রামের বাড়িতে।
ছেলের আচার-আচরণে বিদ্যাসাগর এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন,
‘পিতা
ও মাতা হওয়া অপেক্ষা
অধিকতর মহাপাতকের ভোগ আর নাই।
পিতামাতাকে প্রকৃত প্রস্তাবে সুখী করেন,
এরূপ পুত্র অতি বিরল, কিন্তু অসদাচরণ ... প্রভৃতি দ্বারা পিতামাতাকে যাবজ্জীবন দগ্ধ করেন এরূপ পুত্রের সংখ্যাই অধিক।’
শেষ
পর্যন্ত পুত্রের দ্বারা দগ্ধ বিদ্যাসাগর পুত্রকে চিরতরে ত্যাজ্যপুত্র করেন!
বিদ্যাসাগর তার পরিবার আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে চিরতরে সম্পর্ক ছেদ করার আগে প্রায় প্রত্যেককে একটি করে চিঠি লিখেছিলেন।
সেই চিঠিগুলো পড়লে অনুভব করা যায় যে, তিনি কতখানি গভীর ভাবে বেদনাহত হয়েছিলেন, একাকী কতখানি নৈরাশ্যের জীবনকে তিনি বহন করেছিলেন।
তিনি পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কে চিঠিতে লিখেছেন,
'সংসার বিষয়ে আমার মত হতভাগ্য আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিয়াছি। কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি, সে বিষয়ে কোন অংশে কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই। যে সকলকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা পায়, সে কাহাকেও সন্তুষ্ট করিতে পারে না।’ ....
আবার ওই একই দিনে মাকে একটি আলাদা
চিঠিতে তিনি লিখেছেন,
'নানা কারণে আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে, আর আমার ক্ষণকালের জন্যও
সাংসারিক কোন বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত কোন সংশ্রব রাখিতে ইচ্ছা নাই।‘ চিঠির শেষের দিকে লিখেছেন,
'এক্ষণে আপনার শ্রীচরণে এ
জন্মের মত বিদায় লইতেছি।’...
স্ত্রী দিনময়ী দেবীকে লিখেছেন : ‘আমার সাংসারিক সুখভোগের বাসনা পূর্ণ হইয়াছে আর আমার সে বিষেয় অণুমাত্র স্পৃহা নাই।...
এখানেও চিঠির শেষে লিখেছেন,'এক্ষণে
এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি।’.....
বীরসিংহ গ্রাম প্রধান গঙ্গাধর পালকে চিঠিতে
লিখেছেন,
" নানা কারণ বশতঃ স্থির করিয়াছি আমি আর বীরসিংহায় যাইব না। তুমি গ্রামের প্রধান , এই জন্য তোমাদ্বারা গ্রামস্থ সর্বসাধারণ লোকের নিকট এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি।"
আলাদা
আলাদা এই প্রত্যেক চিঠিতে তার একটিই কথা
"এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি!” ......
অসাধারণ কৃতী মেধাবী এই মহাজীবনের এই যে ... এই যে ..স্বেচ্ছানির্বাসনের সংকল্প, তা দেখে মনে পড়ে যায় , ধ্রুপদী সাহিত্যের সেই মহানায়কদের জীবনের ট্রাজেডির লোককথা।
তবে সমালোচকরা একথাও বলেন যে, বিদ্যাসাগরের বিষাদকে, তার নৈরাশ্যকে শুধু পারিবারিক বিরোধ ও আশাভঙ্গের দ্বারা
ব্যাখ্যা করা যায় না। বৃহত্তর সমাজের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অপ্রত্যাশিত বিরোধিতা তাকে এতটাই আঘাত করেছিল যে তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রতি হয়ে পড়েছিলেন চরম উদাসীন।..... প্রতিপক্ষের নিন্দা ও কুৎসাকে যে বিদ্যাসাগর অনায়াসে উপেক্ষা করেছিলেন, সমাজের বিরোধিতাকে যে বিদ্যাসাগর মোকাবেলা করেছিলেন অকুতোভয়ে, সেই বিদ্যাসাগরই গভীরভাবে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কেননা , সে আঘাত ছিল যেমন অপ্রত্যাশিত ও অপ্রত্যক্ষ, তেমনি তা গভীর, গোপন ও অন্তঃক্ষরা।
সমাজ সংস্কারে যাঁরা তাঁকে সমর্থন করেছেন, যাঁদের জেনেছেন মিত্র বলে, সামাজিক প্রতিরোধের মুখে তাঁদের অনেকের পশ্চাদপসরণ ও আন্তরিকতার অভাব, অমনোযোগ, স্ববিরোধিতা ও ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধি
তাঁকে ভিতরে ভিতরে গভীরভাবে রক্তাক্ত করেছিল অথচ তা সবসময় তিনি প্রকাশও করতে পারেন নি, আবার উপেক্ষাও করতে পারেন নি।
কাশীনাথ তর্কালঙ্কার, ভবশঙ্কর বিদ্যারত্ন, রামতনু তর্কসিদ্ধান্ত, ঠাকুরদাস চূড়ামণি, হরিনারায়ণ তর্কসিদ্ধান্ত, মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ প্রমূখ বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা প্রথমে প্রকাশ্যে বিধবাবিবাহকে সমর্থন করেন ......আবার পরবর্তী সময়ে প্রকাশ্যেই তাঁরাই বিধবাদের বিয়ের চরম বিরোধিতা করলেন । বিদ্যাসাগর বিস্মিত হলেন।
শুধু তাই নয় রাজা রামমোহন রায়ের ছেলে বিদ্যাসাগরের বিশিষ্ট বন্ধু রমাপ্রসাদ রায়, ব্রাহ্মসমাজের তরুণ তুর্কি নেতা কেশব সেন, বিধবা বিবাহের উচ্চকিত সমর্থক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, মেদিনীপুরের প্রগতিশীল মানুষ বলে চিহ্নিত কেদারনাথ দাস ----- পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনায় কমবেশী জারিত এরকম আরো বুদ্ধিজীবী মানুষ বিধবা বিবাহের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সময় হঠাৎই বিদ্যাসাগরের পেছন থেকে নিজেদেরকে নির্লজ্জভাবে সরিয়ে নেন।এমন কি, বহুবিবাহ প্রথা যে একটা জঘন্য প্রথা তা স্বীকার করে নিলেও আইন প্রণয়নের জন্য চেষ্টা করার সময় বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করেছিলেন তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ও তারানাথ তর্কবাচস্পতি ।
বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করলেন, তার এই মেরুদন্ডহীন বুদ্ধিজীবী বন্ধুকূল সমাজ চ্যুত হওয়ার ভয়ে, মর্যাদা ভ্রষ্ট হওয়ার ভয়ে আসলে তোষামোদে এক পরজীবী সম্প্রদায়ে পরিগণিত হয়েছে। বন্ধুদের এই রূপান্তর বিদ্যাসাগরের জীবনে মর্মান্তিক অভিঘাত তৈরি করেছিল,বলাবাহুল্য।ফলস্বরূপ একের পর এক বিদ্যাসাগরের জীবনী ঘটেছে শোচনীয় বন্ধুবিচ্ছেদ।
পাশাপাশি এ কথা অনস্বীকার্য যে নব্য পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনা জারিত বুদ্ধিজীবীর সম্প্রদায়ের অনেকে বিদ্যাসাগরকে যেভাবে ......যে তীব্রতায় আক্রমণ করেছেন, তাতে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন।।
রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, নবগোপাল মিত্র, এমন কি, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় –এঁদের ক্রমান্নয়ী ন্যক্কারজনক আক্রমণে বিদ্যাসাগর নিদারুণভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।
সর্বোপরি, আরো দুটি বিষয়ের উল্লেখ না করলে এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, আর তা হলো বিদ্যাসাগর শেষ জীবন বিষাদসাগরে পরিণত হয়েছিল, তাঁর অন্যতম আরও দুটি কারণ হলো --- এক. বন্ধুমৃত্যু ....দুই. প্রবল অর্থাভাব !
তবে আলোচনাকে আর দীর্ঘ না করে সংক্ষেপে যে বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই বক্তব্য শেষ করতে চাই তা হলো এই যে, বিদ্যাসাগর ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন তাঁর শেষ জীবনে।
বাঙালির মানসিক বৈকল্য , পঙ্গুত্ব, নীতিহীনতা, দুর্বলতার কারণে তিনি যেন জীবন থেকে এক বিষম দূরত্বে অবস্থান করছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ এই অভিমত পোষণ করেছিলেন যে, বিদ্যাসাগর সমকালীন শিক্ষিত সমাজকে অতিক্রম করে এলিট শ্রেণীর মধ্যে সহজেই প্রবেশ করেছিলেন সত্য, কিন্তু সেখানেও তার স্থান ছিল অনেক দূরে--- এক নিভৃত কোনে।.....
এবং নিঃসঙ্গ এই মানুষটি সহজেই সেই এলিট শ্রেণীকেও অতিক্রম করে কালজয়ী এক মহাকাব্যিক চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন।
অবশেষে বিষাদগ্রস্থ, অবসন্ন, ক্লান্ত বিদ্যাসাগর সামাজিক সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। কলকাতার জীবনকে পরিত্যাগ করে, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবকে পরিত্যাগ করে, সাঁওতাল পরগনার কার্মাটাঁড়ে একান্ত নিভৃতে জীবন অতিবাহিত করতে শুরু করেন। সাঁওতালদের সরল সান্নিধ্যে মানসিক শান্তির খোঁজে ব্রতী হলেন।
জীবন সায়াহ্নে অসুস্থতার কারণে কলকাতায় ফিরে আসলেন।
২৯শে জুলাই, ১৮৯১
বাদুড়বাগানের বাড়িতে রাত ১১ টানাগাদ
চিরকালের জন্য থেমে গেল এক ক্লান্ত মহাজীবন।
ক্ল্যাসিক্যাল ট্রাজিডীর নায়কদের মতো তিনি এক অসম-দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং ট্রাজেডীর শুভ-অশুভের দ্বন্দ্বে লিপ্ত আলোকসামান্য নায়কদের মতোই পরাজিত হয়েছিলেন।
পরাজিত হয়েছিলেন সত্য কিন্তু কখনোই পরাভূত হননি। বিদ্যাসাগরই আজও একজন অনন্যসাধারণ বাঙালি বীর,
কিন্তু এক অর্থে একজন ট্রাজিক পুরুষও বটে। ---- যাকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন
proud, silent, lonely man.........
.........................................................
তথ্যঋণ:
১) বিদ্যাসাগর by শঙ্খ ঘোষ
২) আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) বিক্ষত বিদ্যাসাগরের নির্বেদ ও নৈরাশ্য by আলী আনোয়ার
৪) প্রহর
Comments
Post a Comment