ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর vs তারানাথ তর্কবাচস্পতি : ঐতিহাসিক লড়াই

১৮৪৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বর।

গঙ্গার ঘাট পেরিয়ে একজন খর্বকায় বাঙালি পণ্ডিত হন হন করে ছুটে চলেছেন বর্ধমানের কালনার দিকে। রাত থাকতেই তিনি কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলেন। তার গন্তব্য ছিল কালনারই শ্যামরাইপাড়া। সেখানেই থাকেন একজন অত্যন্ত মেধাবী পন্ডিত, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ইবি কাউয়েল সাহেব যাকে আখ্যা দিয়েছিলেন, living encyclopaedia of Sanskrit college. বাস্তবিকই সারা বাংলা জুড়ে তখন তার পাণ্ডিত্যের বিপুল খ্যাতি।


তা, কলকাতার যে খর্বকায় মানুষটি শীতের সেই দুপুরে একমনে হনহন করে হেঁটে চলেছেন শ্যামরাইপাড়ার দিকে, আগের দিনই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ মার্শাল সাহেব তাকে ডেকে বলেছিলেন যে, আপনি তো জানেন, সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের শিক্ষক হরনাথ তর্কভূষণ সদ্য প্রয়াত হয়েছেন । তার পদটি খালি হয়েছে। ওই পদে একজন পণ্ডিতকে কালবিলম্ব না করে নিয়োগ করতে হবে। আমার উপর একজন পণ্ডিতের নাম সুপারিশ করার গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন শিক্ষাদপ্তরের স্বয়ং সেক্রেটারি ময়াট সাহেব । তা, আমি সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক পদে আপনার নামটি সুপারিশ করতে চাই।

মার্শাল সাহেবের সেই কথা শুনে খর্বাকায় পণ্ডিত মহাশয় বলেছিলেন:

“'আমি তো একটি চাকরি করছি। আমার চেয়েও যোগ্যতর ব্যক্তি আছেন যাকে, আপনি সচ্ছন্দে ঐ পদে নিযুক্ত করতে পারেন।' পন্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতির নাম তিনি প্রস্তাব করেন।"

....... ...... .....

হ্যাঁ, খর্বকায় সেই পণ্ডিত মহাশয় আর কেউ নন, তিনি হলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনিই চলেছেন কালনার শ্যামরাইপাড়ার মেধাবী সেই পন্ডিত, সর্ববিদ্যাবিশারদ তারানাথ তর্কবাচস্পতির বাড়ি। তার লক্ষ্য একটাই, তারানাথ তর্কবাচস্পতি যেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকের চাকরিটি গ্রহণ করেন।

অবশ্য তিনি নিজে সেই চাকরিটি গ্রহণ করতে পারতেন, তাতে তার মাস মাইনে ৫০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াতো ৯০ টাকা। যদিও তখন তার টাকার খুবই দরকার ছিল, কিন্তু অগ্রজ পন্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতির কাছে তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

ছাত্রজীবনেই তো তারানাথ তর্কবাচস্পতি তাকে পড়াশুনার জন্য প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। ঠনঠনিয়ার নিজস্ব বাড়িতেই তারানাথ তর্কবাচস্পতি তাঁকে সাহিত্যদর্পন অধ্যয়নের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রকে সবার কাছে কলেজের একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবে তিনিই প্রচার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন:

“আমরা এই বালককে কলেজের মহামূল্য অলংকারস্বরূপ জ্ঞান করে থাকি।"

সেসব ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একদমই ভোলেননি। তাই তো তিনি ছুটে এসেছেন সুদূর কলকাতা থেকে, প্রায় ৫৮ মাইল পায়ে হেঁটে বর্ধমানের কালনায়।


যাইহোক, সেদিন ভরদুপুরে তর্কবাচস্পতির বাড়িতে পৌঁছে বিদ্যাসাগর দেখলেন পন্ডিতমশাই ছাত্রদের তখনও পড়াচ্ছেন। বিদ্যাসাগর কালক্ষেপ না করে, ময়াট সাহেব এবং মার্শাল সাহেবের কথার প্রসঙ্গ টেনে তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপনার চাকরিটি গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন।

বিস্মিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি যেন একটু ইতস্তত করছিলেন, আসলে সেখানেই তো তার বইয়ের ব্যবসা তখন ফুলেফেঁপে উঠেছে, তার লেখা বইয়ের জনপ্রিয়তা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। পাশাপাশি তিনি যেমন নেপাল থেকে কাঠ এনে বাজারে বিক্রি করতেন, তেমনি সিদ্ধ চালের ব্যবসাও বেশ লাভজনক করে তুলেছিলেন।

বিদ্যাসাগর সব বুঝেই বললেন যে, পরে সব কিছুরই ব্যবস্থা করা যাবে। তিনি সে কাজে সাহায্যও করবেন, কিন্তু এই চাকরির সুযোগটি তাকে গ্রহণ করতেই হবে।

এককথায় বিদ্যাসাগর একদমই নাছোড়। অগত্যা তারানাথ তর্কবাচস্পতি চাকরির আবেদনপত্রে সই করলেন। বিদ্যাসাগর সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ চাকরির সেই আবেদন পত্রটি নিয়ে সেদিনই কলকাতায় রওনা দিলেন।


পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ২৩শে জানুয়ারি, বিদ্যাসাগরের অভূতপূর্ব চেষ্টা ও পরিশ্রমের দরুন তারানাথ তর্কবাচস্পতি মাসিক ৯০ টাকা বেতনে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হলেন।

বলাবাহুল্য, বন্ধুর জন্য বিদ্যাসাগরের এমন নিঃস্বার্থ পরোপকারী কাজ সে যুগের বিদ্বৎসমাজকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করেছিল। 

সেই শুরু হয়েছিল বিদ্যাসাগর ও তারানাথ তর্কবাচস্পতির মধ্যে নিবিড় এক বন্ধুত্ব। বিদ্যাসাগর যখন সারা দেশজুড়ে বিধবা বিবাহ আন্দোলন শুরু করলেন, ১৮৫৫ সালে, বন্ধু তারানাথ তর্কবাচস্পতি সে সময় কিন্তু বরাবর তার পাশেই ছিলেন।

 বিদ্যাসাগরের জীবনীকাররা জানিয়েছেন, “বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবাবিবাহের স্বপক্ষে যখন সই সংগ্রহ চলছে, তার দ্বিতীয় সইটি করেছিলেন এই তারানাথই।”

আবার, স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগরকে তিনি দিয়েছিলেন উপযুক্ত সঙ্গত। কলকাতা শহরে বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় বেথুন সাহেব মেয়েদের জন্য প্রথম যে স্কুল তৈরি করেছিলেন, ১৮৪৯ সালের ৭ই মে, ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল --- পরে যার নাম হয়েছিল বেথুন স্কুল, সেই স্কুলে বন্ধু তারানাথ তর্কবাচস্পতি নিজের কন্যা জ্ঞানদাদেবীকে সেখানে ভর্তিও করেছিলেন।

আবার শুনলে অবাক হবেন যে, বিদ্যাসাগরের ছেলে নারায়ণচন্দ্র যখন কৃষ্ণনগরের বিধবা কন্যা ভবসুন্দরী দেবীকে বিয়ে করেন, ১৮৭০ সালের ১১ই আগস্ট, বিয়ের রাতে বিদ্যাসাগরের কোন আত্মীয় বরকন্যাকে বরণ করতে এগিয়ে আসেন নি।

“তারানাথ তর্কবাচস্পতি তখন বাড়িতে গিয়ে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে এলেন। তারানাথের স্ত্রী বরকন্যাকে বরণ করলেন।"

তা, বিদ্যাসাগর ও তারানাথ তর্কবাচস্পতির এই অন্তরঙ্গতা, এই বন্ধুত্ব কখনোই কিন্তু চিরস্থায়ী হয়নি। এক অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্যে দিয়ে চির বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন এই দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু।

#

অন্য কারো মাধ্যমে বিদ্যাসাগর যদি কখনো শুনতে পেতেন যে, কেউ তার নিন্দামন্দ করছে, তিনি সহাস্যে বলতেন, ‘রও ভেবে দেখি, সে আমার নিন্দে করবে কেন? আমি তো কখনো তার উপকার করিনি।‘ 

তাঁর এই রসিকতার কারণ আমরা সবাই বোধহয় জানি, যাদের তিনি উপকার করেছিলেন, তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর জীবনে সবচেয়ে বেশি ক্ষত তৈরি করেছেন।

তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকের চাকরি পাইয়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ২৮বছর ধরে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপকের চাকরি করার সুবাদে, বা বলা যায় বিদ্যাসাগরের দৌলতে তারানাথ তর্কবাচস্পতি অর্জন করেছিলেন প্রভূত অর্থ এবং দেশ-বিদেশের সামাজিক সম্মান, মর্যাদা। বলাবাহুল্য, যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর জন্য তার এই প্রভাব-প্রতিপত্তি, তার অবদানকে তিনি একসময় বেমালুম ভুলেই গেলেন। 

শুধু তাই নয়, তৈরি করলেন বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারের কাজে তীব্র বিরোধিতা, যে বিরোধিতার দরুন অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছিল এই দুই বন্ধুর মধ্যে ঐতিহাসিক চমকপ্রদ এক লড়াই।

আপনারা জানেন, "বহুবিবাহ বিষয়ে বিদ্যাসাগরের প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে ১৮৭১ সালের ১০ই আগস্ট। বইখানার নাম: ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার।”

তা, এই বই প্রকাশিত হওয়ার পরেই দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, ক্ষেত্রনাথ স্মৃতিরত্ন, গঙ্গাধর কবিরত্ন প্রমূখ ঘোর সংরক্ষণশীল পণ্ডিতদের সাথে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন বিদ্যাসাগরের এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারানাথ তর্কবাচস্পতি। 

বিদ্যাসাগর যেখানে বললেন, বহুবিবাহ প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়, সেখানে তারানাথ তর্কবাচস্পতি বললেন, বহুবিবাহ অবশ্যই শাস্ত্রসম্মত। 

এরপরেই বিদ্যাসাগর প্রকাশ করেছিলেন বিধবাবিবাহ বিষয়ক তার দ্বিতীয় বই। বইয়ের নাম একই রইল: “বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার”। প্রকাশিত হল ১৮৭৩ সালের পয়লা এপ্রিল।

তারানাথ তর্কবাচস্পতি বিদ্যাসাগরের বিপক্ষে সংস্কৃত ভাষায় একটি বই বার করলেন। তিনি লিখলেন:

“বহুবিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত ইহা আমার চিরসিদ্ধান্ত আছে এবং বরাবর কহিয়া আসিতেছি এবং এক্ষনেও কহিতেছি যে, বহুবিবাহ সর্ব্বদেশে প্রচলিত ও সর্ব্বশাস্ত্রসম্মত ও চিরপ্রচলিত, তদ্বিষয়ে বিদ্যাসাগরের মতের সহিত আমার মতের ঐক্য না হওয়ায় দুঃখিত হইলাম।“

সর্বশাস্ত্রবিশারদ মেধাবী পন্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতির এই বক্তব্য জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ার পরেই ১৮৭৩ সালের সেই এপ্রিল মাসেই আচমকা বাজারে একটি বই প্রকাশিত হলো। বইটির নাম ‘অতি অল্প হইল’। শুনলে তাজ্জব হবেন যে বইটির লেখক ছিলেন ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’! আজ্ঞে হ্যাঁ, লেখকের নাম ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’। 

বইটি পড়ে কলকাতার লোকজন হেসেই অস্থির। লেখকের নাম আর বইয়ের ভাষা দেখে সবাই সহজেই অনুমান করলো যে বিদ্যাসাগরই বেনামীতে বইটি লিখেছেন। বইটিতে তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে খুড়ো বলে সম্মোধন করে কখনো তীব্র শ্লেষের মাধ্যমে, কখনো বা চাঁচাছোলা ভাষায় তাঁর তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।

তাছাড়া বইটিতে কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ নিয়ে বিদ্যাসাগর তর্কবাচস্পতির ভুল ধরলেন। তিনি জানালেন যে তর্ক বাচস্পতি লিখেছেন, “বাত্যয়া ঘূর্ণায়মানধূলিচক্রমিব” অর্থাৎ বাতাসে ঘুরন্ত ধূলোর চাকার মত বা ঘূর্ণির মতো। সেখানে বিদ্যাসাগর পরিষ্কার বললেন যে শব্দটি ঘূর্ণায়মান হবে না, হবে ঘূর্ণমান বা ঘূর্ণ্যমান।

ব্যস্, আগুনে ঘৃতাহুতি হল যেন। একেই খুড়ো সম্বোধনে তর্কবাচস্পতি মশাই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন, তার উপর তার মতো একজন সংস্কৃত ভাষার মহাপণ্ডিতের ভুল ধরা! তিনি আবার প্রতিবাদী ছোট্ট একটা বই প্রকাশ করলেন।

বইটিতে প্রথমেই তিনি লিখলেন, ভাইপো শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় নেই। শব্দটি ব্যাকরণগত ভাবে সম্পূর্ণ অশুদ্ধ। সুতোরাং বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত জ্ঞানই নেই। 

আর ঘূর্ণায়মান শব্দটি প্রসঙ্গে বললেন ব্যোপদেবের মুগ্ধবোধ এবং পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী --- এই দুই ব্যাকরণের সূত্র অনুযায়ী ঘূর্ণায়মান শব্দটি তৈরি করা যায়। এছাড়া তিনি জবরদস্ত উদাহরণ দিলেন। তিনি বললেন ঘূর্ণায়মান শব্দটির বাস্তব প্রয়োগ আছে। তিনি ‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি প্রকাশ' বই থেকে একটা লাইনও তুলে দিলেন:

“ঘূর্ণায়মান ঘূর্ণসংঘাতবৎ”!

তা, তারানাথ তর্কবাচস্পতির জোরালো যুক্তি শুনে বাংলার বিদ্বৎসমাজ ভাবল, তর্কবাচস্পতি মশাইয়ের মত এত বড় একজন সর্বশাস্ত্রবিশারদ, মেধাবী পন্ডিত -- তিনি কি আর মিথ্যে বলছেন! বিদ্যাসাগর এবার বেশ জব্দ হয়েছেন। এই লড়াইয়ে বিদ্যাসাগরের অবধারিত পরাজয় ।

কিন্তু বিদ্যাসাগর কোনোকালেই সহজে ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। জন্মের পর থেকেই তাঁকে বলা হত এঁড়ে বাছুর। লড়াই করার অদম্য জেদ আর আর এক সুদৃঢ় মানসিকতাকে তিনি আজীবন তার চলার পথের সঙ্গী করেছিলেন। বহু পরিশ্রম করে, দিনরাত এক করে তিনি তর্কবাচস্পতির উল্লেখিত সমস্ত বইগুলিকে জোগাড় করলেন। আর তারপরেই তর্কবাচস্পতির সমস্ত যুক্তিকে খন্ডন করে পাল্টা জবাব হিসেবে আবার একটি বই লিখলেন। বইটির নাম ছিল: 'আবার অতি অল্প হইল’! লেখক সেই ‘উপযুক্ত ভাইপোস্য’! বইটি প্রকাশিত হলো একই বছরে, ১৮৭৩ সালের আগস্ট মাসে! সেখানে তিনি প্রথমেই লিখলেন:

 “এত বড় পন্ডিত ও এত বুদ্ধিশীল হইয়া কোন্ বিবেচনায় ‘ভাইপোস্য' এই বিশুদ্ধ প্রয়োগটিকে অশুদ্ধ বলিয়া নির্দেশ করিলেন, বুঝিয়া ওঠা কঠিন। ‘ভাইপোস্য' এই প্রয়োগটি দুটি সংস্কৃত পদে ঘটিত। ‘ভাইপো:' ‘অস্য’ – এই দুই পদে সন্ধি হইয়া ‘ভাইপোস্য’ প্রয়োগটি সিদ্ধ হইয়াছে।“


 এছাড়া তর্কবাচস্পতির ‘ঘূর্ণায়মান' শব্দটি প্রসঙ্গে পরিষ্কার প্রমাণসহ বিদ্যাসাগর দেখিয়ে দিলেন যে, ব্যোপদেবের মুগ্ধবোধ এবং পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী --- এই দুই ব্যাকরণের সূত্রে ঘূর্ণায়মান শব্দটি তৈরীর কথা একদমই নেই।


আর সবশেষে বিদ্যাসাগর হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন। পাঠকদের সামনে তুলে ধরলেন তারানাথ তর্কবাচস্পতির শব্দজোচ্চুরি। তিনি দেখিয়ে দিলেন, তারানাথ তর্কবাচস্পতি মশাই নিজের বক্তব্যের সমর্থনে “ন্যায়কুসুমাঞ্জলি প্রকাশে”র যে লাইনটি লিখেছেন, সেখানে ঘূর্ণায়মান শব্দটিই নেই। সেখানে আছে ঘূর্ণমান। আসল লাইনটি হল:

 “ঘূর্ণমানঘুনসংঘাতবৎ”! ....... অর্থাৎ তারানাথ তর্কবাচস্পতি পাঠকদের বোকা বানিয়েছেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তিনি লজ্জাজনকভাবে অসদুপায় অবলম্বন করেছেন, অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। 


বলাবাহুল্য বিদ্যাসাগরের ধারালো যুক্তি প্রমাণের কাছে চরম অপদস্ত হয়ে তারানাথ তর্কবাচস্পতি অবশেষে রণে ভঙ্গ দিলেন। বিদ্যাসাগরের সাথে সেই নজিরবিহীন লড়াইয়ে নিদারুণভাবে পরাজিত হবার পর তিনি আর কোনো উচ্চবাচ্য করতে পারলেন না। 

তবে তার পক্ষে সে সময় অনেক বিদগ্ধ মানুষ কলম ধরেছিলেন, যাদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছিলেন, শুনলে বিস্মিত হবেন, তার নাম সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি তার বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে অকল্পনীয় বিষোদগার করেছিলেন। 

অভিযোগ ছিল একটাই, আর তা হলো, বিদ্যাসাগর নাকি ঈর্ষাজনিত কারণে, আত্মপ্রতিষ্ঠার আবেগে নিম্নশ্রেণীর মানুষের মতো তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন --- যা একজন জ্ঞানী পন্ডিত মানুষের পক্ষে কখনই শোভা পায় না।


আর বিদ্যাসাগর সেই ঐতিহাসিক তর্ক-বিতর্কে জয়ী হয়েও, তিনি হারিয়ে ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে। আজীবনের জন্য তাদের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বে নেমে এসেছিল মর্মান্তিক চিরবিচ্ছেদ। জীবনের লড়াইয়ের পথে বিদ্যাসাগর হয়েছিলেন আরো নিঃসঙ্গ একাকী এক যোদ্ধা।


বিদ্যাসাগরের আসন্ন জন্মদিন উপলক্ষে তাকে আমার হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানিয়ে আজ এখানেই শেষ করছি।


( বিনা অনুমতিতে যে কোনরকম ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ  / Copyright @ The Galposalpo Youtube Channel)

...............................................................

তথ্যঋণ:

১) বিদ্যাসাগর By বিহারীলাল সরকার

২) বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ : ৩য় খন্ড By বিনয় ঘোষ

৩) বিদ্যাসাগর : নানাপ্রসঙ্গ By রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

৪) করুণাসাগর বিদ্যাসাগর By ইন্দ্রমিত্র

৫) অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায় : আনন্দবাজার পত্রিকা

৬) বাংলাহান্ট ডট কম




Comments

Popular posts from this blog

জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্যদেবী : বিয়ের গল্প / Jibanananda Das and Labanya Debi : Marriage Story

বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম : উত্থান-পতনের আশ্চর্য ইতিহাস / History : Vande Mataram by Bankim Chandra

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : প্রথম চুম্বন, মদ্যপান আর প্রেমের গল্প / Sunil Gangopadhyay : Story of First Kiss, Wine and Love