মহালয়া বেতার অনুষ্ঠানের আশ্চর্য গল্প / Unbelievable Story of Mahalaya Radio Programme

মহালয়া বেতার অনুষ্ঠানের আশ্চর্য গল্প / Unbelievable Story of Mahalaya Radio Programme



মহালয়া । এই  রেডিও অনুষ্ঠানটি যখন লাইভ সম্প্রচারিত হত, সেসময় অনুষ্ঠানের আগে কঠোর নিয়মনিষ্ঠার সাথে টানা তিন মাস রিহার্সাল চলতরিহার্সাল করাতেন অনুষ্ঠানের মূল পরিকল্পনা যার, সেই বাণীকুমার যার আসল নাম ছিল বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য কোন শিল্পীই সেই রিহার্সাল অবহেলা বা উপেক্ষা করতে পারতেন না। যত অসুবিধাই থাক রিহার্সালে হাজিরা  দিতেই হবে তা, প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায় একসময় মহালয়া অনুষ্ঠানটির সাথে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। অনুষ্ঠানে 'জয় দুর্গা' গানটি  তিনিই বরাবর করতেন।

     সে বছর কি হলো, সালটা ছিল ১৯৫০.  মুম্বাই আর টালিগঞ্জের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে প্রবল ব্যস্ত ছিলেন হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায় ব্যস্ততার দরুন তিনি রিহার্সালে সময় দিতে পারলেন না। বাণীকুমারকে তিনি অনুরোধ করলেন, তাকে যেন সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়, তিনি পরে অনুষ্ঠানের আগেই কয়েকদিন রিহার্সাল করে অনুষ্ঠানে গান গেয়ে দেবেন। কিন্তু বাণীকুমার ছিলেন ভীষণ নিয়মনিষ্ঠ মানুষ। তিনি হেমন্ত কুমারের অনুরোধ সবিনয়ে সরিয়ে দিলেন। তার বক্তব্য ছিলযত বড় শিল্পীই হও, সকলের সঙ্গে নিয়ম মেনে রিহার্সাল তোমাকে করতেই হবে। নয়তো সেটি বাকিদের প্রতি অবিচার হবে।"

  বাণীকুমার অবশেষে হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়কে মহালয়ার অনুষ্ঠান থেকে সরিয়ে দিলেন। হেমন্ত কুমারের পরিবর্তে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে মহালয়ার অনুষ্ঠানে গান গাওয়ানো হল। মহালয়াতে একক সংগীতে সেই প্রথম দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের অভিষেক। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, মহালয়া রেডিও অনুষ্ঠান নিয়ে বাণীকুমার কতখানি সিরিয়াস ছিলেন হবে নাই বা কেন, এরকম  সিরিয়াসনেস ছিল বলেই না আজ মহালয়া অনুষ্ঠানটির এইরকম গগনচুম্বী উচ্চতা

চলুন আজ মহালয়ার অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু কথা বলা যাক

#

১৯৩১ সালের মার্চ মাস।

রেডিও থেকে প্রচারিত হলো একটি অসাধারণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠানটির নাম ছিল 'বসন্তেশ্বরী' পুরো অনুষ্ঠানটির ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছিলেন স্বনামধন্য বাণীকুমার। গান গল্প আর চণ্ডীপাঠে ভরপুর সেই অনুষ্ঠান রাতারাতি অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছিল সেই অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে রেডিওর প্রতি মানুষের আকর্ষণ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, তৎকালীন রেডিও ডিরেক্টর এন মজুমদার  বানীকুমারকে বললেন, পরের বছরের জন্য তৈরি হন। এরকমই একটা আলেখ্য লিখে রেডি করে ফেলুন।

তা পরের বছর, ১৯৩২ সালে মহিষাসুর বধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাণীকুমার একেবারে নতুন ধরনের একটি গীতিআলেখ্য তৈরি করলেন

ডিরেক্টর এন মজুমদার সেই গীতিআলেখ্যটি রেডিওতে সম্প্রচারের জন্য মহালয়ার দিন নয়, মহাষষ্ঠীর ভোরবেলা বেছে নিলেনঅনুষ্ঠানটির নতুন নামকরণ হলো --- 'শারদীয় বন্দনা। মূল স্ক্রিপ্টরাইটার ছিলেন বাণীকুমার, সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং হরিশচন্দ্র বালী। বাদ্যযন্ত্র পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। আর  চন্ডী স্তোত্রপাঠে ছিলেন এক, অদ্বিতীয়ম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

১৯৩৩ সালেও একই সময়ে একই গীতিআলেখ্য 'শারদীয় বন্দনা' সম্প্রচারিত হল

১৯৩৪ সালে কিন্তু বড়োসড়ো একটা পরিবর্তন ঘটল বাণীকুমারের প্রস্তাবে অনুষ্ঠানটি সেই প্রথম মহাষষ্ঠীর ভোরবেলার বদলে মহালয়ার ভোরবেলা প্রচারিত হলো।

#

এর পরেই কিন্তু শুরু হলো মহাবিতর্ক বিতর্কের বিষয় ছিল দুটি এক. যেহেতু মহালয়ার দিনে প্রয়াতঃ পিতৃপুরুষেরা তর্পণ নিতে মর্ত্যে হাজির হন, সুতরাং বলা হল, দিনটি শুভ নয়। 'শারদীয় বন্দনা'র মত একটা ভালো অনুষ্ঠান সেই দিনে সম্প্রচার করা মোটেই উচিত নয় বলে রেডিও কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল

আর দুনম্বর বিতর্কের বিষয়টি ছিল মারাত্মক। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যেহেতু কুলীন কায়স্থ, অব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য, সেহেতু আওয়াজ উঠল যে, চণ্ডীপাঠে, স্তোত্রপাঠে তার কোন অধিকার নেই। অর্থাৎ ওই অনুষ্ঠানে চণ্ডীপাঠের দায়িত্বে তাকে কিছুতেই আর রাখা চলবে না

ফলস্বরূপ কোনো উপায়ান্তর না দেখে পরবর্তী দুবছর ১৯৩৫ এবং ১৯৩৬ সালে মহালয়া অনুষ্ঠানটিকে আবার আগের মত মহাষষ্ঠীর ভোরবেলাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল।

এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে রাখা দরকার তা হলো এই যে ১৯৩৬ সালেই কিন্তু সেই অনবদ্য বেতার অনুষ্ঠানটির নতুন নামকরণ করা হলো  'মহিষাসুর বধ

রচনাটি ভিডিওতে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।

তবে এই সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো এটাই যে, চন্ডী স্তোত্রপাঠ থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে কোনভাবেই সরানো হলো নারেডিও অফিসে বারবার হুমকির চিঠি আসলো, তবুও অনুষ্ঠানের মূল পরিকল্পক বাণীকুমার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিবর্তে অন্য কাউকে দিয়ে চণ্ডীপাঠ করাতে কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি ঘোষণা করেই দিয়েছিলেন, 'স্তোত্র পাঠ করলে শুধু বীরেনই করবে, আর কেউ নয়তিনি বলেছিলেনএকটা প্রোগ্রামের আবার হিন্দু-কায়েত কী? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? তাছাড়া এই প্রোগ্রামের বাজনাদাররা তো অধিকাংশ মুসলমান। সেরকম হলে তো ওদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ধরে আনতে হয়

তা সত্যিই শুনলে অবাক হবেন যে, মহালয়ার সেই অনুষ্ঠানটিতে সারেঙ্গী বাজাতেন মুন্সী নামে একজন মুসলমান ভদ্রলোক। চেল বাজাতেন তারই ভাই আলী হারমোনিয়ামে ছিলেন আরেকজন মুসলমান ভদ্রলোক, তার নাম ছিল খুশি মহম্মদ। এ ছাড়াও, আরও বেশ কয়েকজন মুসলমান এবং খ্রিস্টান শিল্পী সে সময় ছিলেন বলাবাহুল্য, অনুষ্ঠানটিতে যদিও দেবী দুর্গার জয়োগাঁথা ছিল, তবুও অনুষ্ঠানটিতে কিন্তু কোন ধর্মের দাপট ছিলনা। অনুষ্ঠানটি ছিল ধর্মমত নির্বিশেষে একটি অসাধারণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এখানে একটি মজার গল্প বলে রাখি। সেসময় সংস্কৃত শ্লোক পাঠের মধ্যে দিয়েই মহালয়া অনুষ্ঠান শুরু হতো। সেই শ্লোক বরাবর পাঠ করতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। একবার কি হলো, স্টুডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পৌঁছাতে একটু দেরি হল।  বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দেরি দেখে তার জায়গায় সেই শ্লোক পাঠ করা শুরু করলেন নাজির মহম্মদ নামে এক মুসলমান শিল্পী। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র সেই শ্লোক পাঠের সময়েই স্টুডিওতে হাজির হলেন। সেদিন তিনি নাজির আহমেদের শ্লোক পাঠ শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন আনন্দলোক পত্রিকায় সায়ক বসু লিখেছেনবীরেন্দ্রকৃষ্ণ এক জায়গায় বলেছিলেন, তিনি পৌঁছনোর পর দেখেন নাজির স্তোত্রপাঠ করছেন। সেই আবেগ এবং উচ্চারণে বীরেন্দ্র এতটাই মোহিত হয়ে যান যে তার মনে হয়নি নাজির মুসলমান।

  ১৯৩৭ সালে উল্লেখযোগ্য দুটি পরিবর্তন হল একদিকে যেমন বেতার অনুষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো মহিষাসুরমর্দিনী, তেমনি অন্যদিকে সে বছর থেকেই প্রতিবছর মহাষষ্ঠীর ভোরবেলার পরিবর্তে স্থায়ীভাবে মহালয়ার ভোরবেলাতেই অনুষ্ঠানটি রেডিও থেকে সম্প্রচারিত করা শুরু হল।

#

 টানা প্রায় ২৫ বছর ধরে লাইভ অনুষ্ঠানের পর  ১৯৬২ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে, এবার থেকে 'মহিষাসুরমর্দিনী' আর লাইভ অনুষ্ঠান করা হবে না, তা এবার থেকে রেকর্ডিং করে রেডিওতে বাজানো হবে। এর মূল কারণ ছিল তিনটি -- প্রযুক্তির অগ্রগতি, শিল্পীদের ব্যস্ততা এবং ভারত চীন যুদ্ধ।  যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বেতার অনুষ্ঠান করা খুব মুশকিল হয়ে পড়েছিল।

 যাইহোক, পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবার পরিবর্তনের পর ১৯৬৬ সালে মহালয়ার ফাইনাল রেকর্ডিং তৈরি হল। ভাবলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না, আজ আমরা রেডিওতে যে মহালয়া শুনি, তা আসলে প্রায় ৫৬ বছর আগের তৈরি করা রেকর্ড। একটানা এরকম একটি অনুষ্ঠান বছরের পর বছর ধরে মানুষকে অভিভূত করে রেখেছে, মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে ---- এরকম ঘটনার নজির বিশ্বের কোথাও আছে কিনা, আমার সত্যিই জানা নেই। বাস্তবিকই মহালয়ার এই অনুষ্ঠানের আজ নিঃসন্দেহে কালোত্তীর্ণ অনন্যসাধারণ এক অনুষ্ঠান যা আসলে বাঙালিয়ানারই অন্যতম পরিচায়ক।



@ copyright owner: The Galposalpo 



Comments

Popular posts from this blog

জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্যদেবী : বিয়ের গল্প / Jibanananda Das and Labanya Debi : Marriage Story

বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম : উত্থান-পতনের আশ্চর্য ইতিহাস / History : Vande Mataram by Bankim Chandra

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : প্রথম চুম্বন, মদ্যপান আর প্রেমের গল্প / Sunil Gangopadhyay : Story of First Kiss, Wine and Love