রাজা রামমোহন রায় : জীবনসংগ্রাম ও বিরোধীপক্ষ

রাজা রামমোহন রায়, তাঁর জীবনসংগ্রাম, তাঁর বিরোধীপক্ষ -- এসব নিয়ে তথ্যনির্ভর আলোচনা করাই এই রচনাটির উদ্দেশ্য। এ কথা অনস্বীকার্য যে, শুধুমাত্র এই একটি প্রচেষ্টাতেই বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়কে আধুনিক ভারতের জনক, ভারতের প্রথম আধুনিক পুরুষ হিসাবে তুলে ধরা যায় না, ব্যাপারটা একদমই অসম্ভব। তবু একটা চেষ্টা শুরু তো  করাই যেতেই পারে।

রাজা রামমোহন রায় (ছবিঃ ইন্টারনেট) 

রাজা রামমোহন রায়ের প্রথম যিনি বিরোধিতা করেছিলেন , তিনি হলেন তার বাবা রামকান্ত রায়। রামকান্ত রায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী তারিণী দেবীর গর্ভে ছোট ছেলে হিসাবে রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে । তারিখ ছিল ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২শে মে।

শৈশবে রাজা রামমোহন রায়ের আশ্চর্য মেধা দেখে এই বাবাই স্থির করেছিলেন যে ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে।  ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করতে হবে। সংস্কৃত পড়তে তিনি ছেলেকে কাশিতে পাঠালেন। ছেলে সংস্কৃতে পন্ডিত হয়ে আসার পরে ফারসি শেখার জন্য তিনি ছেলেকে পাটনা পাঠালেন ছেলে ফার্সিতে পন্ডিত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু এত পন্ডিতি, এত জ্ঞান রাজা রামমোহন রায়ের কাল হলো।  কারণ বাবা রামকান্ত রায় লক্ষ্য করলেন, দেবদেবীর পুজোঅর্চনায় ছেলের  আর বিশ্বাস নেই তিনি  ছেলেকে অনেক বোঝালেন, কিন্তু ছেলে রামমোহন রায় দুর্ধর্ষ এক তার্কিক।  তর্ক বিচারে ছেলের সামনে তিনি মোটেও দাঁড়াতে পারলেন না। অবশেষে  বাবার ধৈর্যচ্যুতি  ঘটলো। তিনি গর্জন করে বললেন, বিধর্মী নাস্তিক কুলাঙ্গার, বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।

১৫ বছরের ছেলে রামমোহন রায় সেই মুহুর্তেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

সে বারেই তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে নেপালে যান, নেপাল থেকে তিনি তিব্বতেও গিয়েছিলেন। চার বছর পরে রামমোহন রায় বাড়ি ফিরলেন। বাবা ভাবলেন, চার বছর ধরে বনেবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে ছেলে নিশ্চয়ই ভালো হয়ে গেছে। ধর্ম নিয়ে নিশ্চয়ই আর কোন উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা নেই। কিন্তু যত দিন যেতে থাকে, ততো   ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টো দিকে মোড় নিল। রামমোহন রায় খোলাখুলি হিন্দু ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। প্রিয় পুত্র রামমোহন রায় বাবার কাছে আগের চাইতে আরো বেশি অসহনীয় হয়ে উঠলেন।   বাবা বুঝলেন যে, তার  ছেলে উচ্ছন্নে গেছে। তিনি আর দেরি না করে রামমোহন রায়কে দ্বিতীয় বারের জন্য  বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। তাড়িয়ে দিলেন রামমোহন রায়কে।

১৮০৩ সালে মারা গেলেন বাবা রামকান্ত রায়। বাবার শ্রাদ্ধ শান্তির জন্য রামমোহন রায়কে আসতে হল দেশের বাড়িতে। কিন্তু ছেলে হিন্দু ধর্মের এক মস্তবড় কুলাঙ্গার, এক ধর্মোচ্যুত বিপথগামী পুরুষ -- এই কঠিন যুক্তিতে  মা তারিণী দেবী রামমোহন রায়কে তাঁর বাবার শ্রাদ্ধের ধিকার দিলেন না। আর এখানেই তিনি তার জীবনের  দ্বিতীয় বিরোধিতার মুখোমুখি হন। এক শক্তিশালী বিরোধীপক্ষ হিসাবে মা তারিণী দেবী তাঁর জীবনে হাজির হলেন।

মা ছেলের সম্পর্ক ক্রমশ অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়েছিল। সম্পত্তির অধিকার নিয়ে ভয়ানক বিরোধ তৈরি হয়েছিল তাঁদের মধ্যে। তারিনি দেবী ছেলের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করে বসেন। ছেলে বিধর্মী, তাই পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী তাঁকে হতে দেওয়া যায় না। রামমোহন রায় কিন্তু  প্রথমে মায়ের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে চাননি।  কিন্তু পরে ঠিক করলেন যে, তিনি মামলা লড়বেন, কারণ তাঁর লড়াই মায়ের বিরুদ্ধে নয়, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

মামলা কোর্টে উঠলো । বিচারের সময় মা তারিনি দেবি কোর্টে ধীরস্থির ভাবে বললেন, ধর্মত্যাগী ছেলের  মন্ডুচ্ছেদ  যদি এখানে  করা হয় , তাহলে তাকে তিনি  অত্যন্ত পূণ্য কাজ, ভালো কাজ বলে মনে করবেন।

মা ছেলের মধ্যে বিরোধিতা যে কোন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল তা সত্যিই বর্ননা করা যায় না। ‌কিন্তু সেই মামলায় ছেলে রামমোহন রায় জয়ী  হলেন। মা পরাজিত হলেন।

মামলায় জয়ী হওয়ার পরে ছেলে তাঁর প্রাপ্ত সম্পত্তি মাকে সসম্মানে কিন্তু ফেরত দিয়ে দিলেন, সেই মাকে যিনি  প্রতিনিয়ত ছেলের মৃত্যু কামনা করছেন।


রাজা রামমোহন রায়ের তৃতীয় বিরোধী পক্ষ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধীপক্ষ । এই বিরোধী পক্ষ ধর্মের ভিত্তিতে তিন ভাগে বিভক্ত ছিল।  একদিকে যেমন ছিল গোঁড়া রক্ষণশীল  ব্রাহ্মণতেমনি অন্যদিকে ছিল গোঁড়া মুসলিমরা আর তৃতীয় ভাগে ছিল তথাকথিত ধার্মিক খ্রীষ্টানরা।   এককথায় রাজা রামমোহন রায়ের এই তৃতীয় বিরোধী পক্ষ মানে ছিল তদানীন্তন সমাজের আপামর  কট্টর প্রাচীনপন্থী মানুষজন।

হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি আচার অনুষ্ঠান নিয়ে  যেদিন থেকে কলকাতার বুকে রাজা রামমোহন রায় শুরু করেছিলেন তার তীব্র সমালোচনামূলক অভিমত প্রকাশ করা, সেদিন থেকেই  হিন্দু সমাজে তৈরি হয়েছিল এক অবর্ণনীয় চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা। শুরু হয়েছিল অবশ্যম্ভাবী প্রকাশ্য বিরোধিতা। ১৮১৫ সালে হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রামমোহন রায় লিখলেন তাঁর প্রথম বই, বেদান্ত ভাষ্য। রক্ষণশীলরা চিৎকার করে উঠলেন, হিন্দু ধর্ম গেল , জাত গেল, ভয়ঙ্কর সর্বনাশ হল।

কিন্তু রামমোহন রায় থামলেন না। হিন্দুধর্মের ময়নাতদন্ত করে তিনি পরপর আরো ছটি বই লিখলেন। বই গুলির নামঃ

বেদান্তসার

কেনোপনিষদ

ঈশোপনিষদ

কঠোপনিষদ

মান্ডুক্যোপনিষদ

এবং মুণ্ডকোপনিষদ।

রাজা রামমোহন রায়ের নতুন চিন্তা আর যুক্তির অস্ত্রে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল হিন্দুধর্মের জীর্ণ পুরনো অসাড় তত্ত্বসমূহ।  আর সাথে সাথেই কলকাতার বুকে তৈরি হল তাঁর অজস্র অগণিত শত্রু

১৮১৫ সালেই সমমনস্ক বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে রাজা রামমোহন রায় নিজের বাড়িতে তৈরি করেছিলেন একটি সংগঠন নাম আত্মীয়সভা --- যা পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিতি লাভ করে।  সংগঠনের সভাগুলিতে আলোচিত হত হিন্দু ধর্মের মূর্তিপূজার অসারতা নিয়ে, আলোচনা হতো বর্ণভেদ প্রথা নিয়ে, আলোচনা হতো সতীদাহ প্রথা নিয়ে। বহুবিবাহের কুফল বা বিধবাবিবাহের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও সদস্যদের মধ্যে মত বিনিময় হত। এখানেই রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তন করেন তাঁর একেশ্বরবাদ।  তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন , বহু ঈশ্বরবাদে তাঁর কোন বিশ্বাস নেই, তিনি একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। তাঁর এই একেশ্বরবাদকে ভিত্তি করেই অচিরেই তৈরি হল  ব্রাহ্মধর্ম

রাজা রামমোহন রায়ের এই সমস্ত কর্মকাণ্ড দেখে রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থীরা ভীষণ ক্ষিপ্ত হলেন। তারা  রামমোহন রায়ের বাড়ির চারিদিকে জড়ো হয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিতে শুরু করলেন।  রাস্তাঘাটে রামমোহন রায়কে নিয়ে তৈরি হলো বিদ্রুপাত্মক গান, ছড়া। রাস্তায় রাজা রামমোহন রায়ের গাড়ি বেরোলে, সে গাড়িকে উদ্দেশ্য করে উড়ে আসত অজস্র ইট-পাটকেল। এমনকি, চারিদিকে রটিয়ে দেওয়া হলো, তিনি বিধর্মী--- তিনি গরুর মাংস খান।

ইতিমধ্যে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে তিনি বললেন, হিন্দু হোক, মুসলমান হোক আর খ্রীষ্টানই হোক, এক ঈশ্বরকে যারা নানারূপে দেখেন,  তারা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, তারা মহা ভুল করছেন। রামমোহন রায়ের মুখে একথা শুনে গোঁড়া মুসলিম ও খ্রিস্টানরা মারাত্মক খেপে উঠলো। সমগ্র বঙ্গপ্রদেশ জুড়ে দিনরাত উচ্চগ্রামে রাজা রামমোহন রায়ের মন্ডুপাত করতে শুরু করলেন সব ধর্মের কট্টরপন্থী মানুষজন।

রামমোহন রায় খ্রিস্টান ধর্মের সমালোচনা করে বই লিখে ফেললেন .... বইটির নাম Precepts of Jesus --- Guide to peace and happiness.. খ্রিস্টানরা ক্ষিপ্ত হল । মিশনারী পাদ্রী উইলিয়াম কেরি এবং মার্শম্যান সাহেব ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়াতে  রামমোহনের তীব্র সমালোচনা করলেন। যে খ্রিস্টান প্রেস থেকে রামমোহন রায় তাঁর বই ছাপাতেন, সেই ছাপাখানার দরজা তাঁর জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল। কিন্তু রামমোহন রায় কিছুতেই দমবার পাত্র নন।  তিনি নিজেই নতুন প্রেস তৈরি করে বই ছাপাতে শুরু করলেন। উইলিয়াম কেরি এবং মার্শম্যানকে জবাব দিতে তিনি সেই প্রেস থেকে বার করলেন তার বই Final Appeal ..... সেই বইতে তিনি মার্শম্যান সাহেবদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে,  খ্রিষ্টান ধর্ম নিয়ে তাদের যে ভাবনা, সেই ভাবনার কোন যুক্তি নেই , কোন বাস্তবতা নেই। রামমোহন রায়ের অসাধারণ মেধা ও পাণ্ডিত্য দেখে খিষ্টান সমাজ অবাক হয়ে গেল,  তারা চুপ করে রইলেন।

রামমোহন রায়ের বিরোধী পক্ষ হিসেবে মুসলিম অথবা খ্রিষ্টানরা চুপ করে গেলেও তাঁর কট্টর বিরোধী পক্ষ গোঁড়া ব্রাহ্মণরা কিছুতেই চুপ করে বসে থাকলেন না।

 অনেক আগে রামমোহন রায়ের জীবনে ঘটে গিয়েছিল এক মর্মান্তিক ঘটনা। তার দাদা  জগমোহন রায়ের স্ত্রী ছিলেন অলকমনি দেবী। এই বৌদিকে রামমোহন রায় অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, মায়ের মতোই তাঁকে ভালবাসতেন।

একদিন দাদা অকালে মারা গেলেন, সে সময় রামমোহন রায় ধারে কাছে উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর অনুপস্থিতিতে ধর্মের নামে রাক্ষস এক সমাজ  অলকমনি দেবীকে জোর করে তাঁর স্বামীর চিতায় তাঁকে পুড়িয়ে মারল। শোনা যায়,  রামমোহন বৌদিকে বাঁচাবার জন্য ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি এসে পৌঁছালেন, তখন সব শেষ হয়ে গেছে। ঢাকের শব্দে, ধুনোর ধোয়ায়,  পৈশাচিক আনন্দে তখন জনতা চিৎকার করছে, জয় সতী অলক মনির জয়।

বৌদির চিতার পাশে সেদিন পাথরের মূর্তির মতো এসে দাঁড়িয়েছিলেন রামমোহন রায়।  এক চোখে তার আগুন আর এক চোখে তাঁর জল ।  সেদিন  তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, জীবনের যে কোনো মূল্যে ভারতবর্ষ থেকে নারী-হত্যার এই পৈশাচিক সতীদাহ প্রথা তিনি চিরদিনের মতো বিলুপ্ত করবেনই।

রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য কলম ধরলেন।  লিখলেন বই। নাম – প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ !  বইতে তিনি প্রমাণ করলেন যে, সতীদাহ প্রথা আসলে  এক অশাস্ত্রীয়  এবং নীতিগর্হিত এক প্রথা। চারিদিকে মহা শোরগোল পড়ে গেল। কট্টর হিন্দুরা রামমোহন রায়ের বিরোধিতায় সব একজোট  হলো।

সে সময়ে অর্থাৎ ১৮২৮ সালে জুলাই মাসে লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতে গভর্নর জেনারেল  হয়ে আসলেন।  তিনি ছিলেন কিছুটা উদার এবং আধুনিক মানসিকতার একজন শাসক। সতীদাহ প্রথা রদ করার জন্য রামমোহন রায় তার কাছে আবেদন করলেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বরে ব্রিটিশ ভারতে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সতীদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করেন। আইন পাস হওয়ার পর কিন্তু কট্টর হিন্দুরা থেমে থাকেননি। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে হলে তাদের আবেদন করতে হবে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে। রামমোহন রায়ের জয়যাত্রা রুখবার জন্য তারা রাতারাতি ‘ধর্মসভা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন।  উগ্র সেই সংগঠনের নেতৃত্বে রামমোহন রায়ের বিরোধীপক্ষ হিসাবে এগিয়ে আসেনঃ

রাধাকান্ত দেব, মহারাজা গোপিকৃষ্ণ, হরনাথ তর্কভূষণ, দেওয়ান রামকমল সেন, জয় কৃষ্ণ সিংহ, মতিলাল শীল,  সাংবাদিক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমূখ রক্ষণশীল ব্যক্তিবর্গ। তারা তাদের পত্রিকা 'সমাচার চন্দ্রিকা'য় রামমোহন রায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে লাগলেন।অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে তারা তখনকার সময়ের  কুড়ি হাজার টাকার একটা অবিশ্বাস্য তহবিল তৈরি করে ফেললেন।  ধর্মসভা' পক্ষ থেকে ফ্রান্সিস বেথি নামে একজন ইংরেজ অ্যাটর্নীকে দিয়ে বিলেতের প্রিভি-কাউন্সিলে ভারতের সতীদাহ প্রথা বলবৎ করার জন্য তারা দরখাস্ত দাখিল করলেন।

তখন দেশের মানুষের একটু একটু করে ঘুম ভাঙছে। রামমোহন রায়ের দলও একটু একটু করে ভারী হয়ে উঠল। তাঁর দলেও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা সক্রিয়ভাবে যোগ দিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন :

রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা দ্বারকানাথ ঠাকুর, টাকির জমিদার কালিনাথ রায়চৌধুরী, তেলিনিপারা জমিদার অন্নদাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, খ্রিস্টান পাদ্রী অ্যাডাম, ভূকৈলাশের রাজা কালিশংকর ঘোষাল, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, ‘সম্বাদ ভাস্কর'-এর সম্পাদক বিখ্যাত পন্ডিত গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

হিন্দুদের দরখাস্তের আবেদনকে মোকাবেলা করার জন্য রামমোহন রায় বিলেত যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। দিল্লির বাদশাহ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তার নিজের প্রয়োজনে রামমোহন রায়কে রাজা উপাধিতে ভূষিত করে ইংল্যান্ডে নিজের দূত হিসেবে প্রেরণ করলেন।

১৮৩০ সালের নভেম্বর মাসে অ্যালবিয়ন নামে একটি জাহাজে চড়ে রাজা রামমোহন রায় বিলেতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অবশেষে লন্ডনে পৌঁছে প্রিভি কাউন্সিলের সামনে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ করার জন্য তিনি রাশি রাশি ধারালো যুক্তি পেশ করেন।

ফলস্বরূপ কট্টর হিন্দু নেতাদের ইংরেজ অ্যাটর্নী ফ্রান্সিস বেদির সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হলো। রাজা রামমোহন রায় বিজয়ী হলেন ভারত বর্ষ থেকে সতীদাহের প্রথা মুছে গেল চিরদিনের জন্য।

রাজা রামমোহন রায়ের জীবনের শেষ দিন বছর কেটেছিল ইংল্যান্ডে। তবে বিলেত যাওয়ার আগে তিনি আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন।  ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে িনি ছিলেন পথপ্রদর্শক। কলকাতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যদিও বিরোধীপক্ষের প্রবল আপত্তিতে মূল কমিটিতে তাঁর নাম বাদ পড়েছিল, তবু একথা সকলেই স্বীকার করেন যে হিন্দু কলেজ,  যার বর্তমান নাম প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, ---তা তাঁর পরোক্ষ সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল।  তাঁরই উদ্যোগে ডাফসাহেব নতুন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। ডাফসাহেবের সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই আজকের স্কটিশ চার্চ কলেজ।

আরেকটি কথা হলো এই যে, অনেকে বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলে মনে করেন, কিন্তু বাস্তবে  রাজা রামমোহন রায়ই হলেন প্রকৃত বাংলা গদ্যের জনক।  তিনি বিদ্যাসাগরের মতো সাহিত্য রচনা করেন নি ঠিকই,  কিন্তু তিনিই প্রথম সহজ সরল ভাষায় বাংলা গদ্যে নিজের যাবতীয় তত্ত্ব প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছেন।

আবার তিনি মেয়েদের অধিকার রক্ষার উপর প্রবল মনোনিবেশও করেছিলেন। তিনি শাস্ত্র ঘেঁটে বলেছিলেন, মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে ছেলের সাথে স্ত্রীও সমান অধিকারী। বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং বহুবিবাহ রদ করার জন্য তিনি যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন,  পরবর্তীকালে সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যান বিদ্যাসাগর।

একথা অনস্বীকার্য যে , বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে রাজা রামমোহন রায় হলেন ভারতের প্রথম আধুনিক পুরুষ , অবশ্যই আধুনিক ভারতের জনক।


উপরের লেখাটি ভিডিওতে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।


Copyright: The Galposalpo

17-05-22

Comments

Popular posts from this blog

সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য : জীবনী বা জীবন কাহিনী / Sadhak Kamalakanta Bhattacharya Life Story or Biography

অদ্বৈত মল্লবর্মণ এক অসামান্য নদীর নাম : অসামান্য জীবনী / Adwaita Mallabarman Life Story

অতুলপ্রসাদ সেন ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের গল্প / Atulprasad Sen Life Story on Forbidden Relationship