গৌতম বুদ্ধ : যে দশটি প্রশ্নে নিরুত্তর ছিলেন / Gautam Buddha Silent at 10 Unanswered Questions

This article is about Gautam Buddha ( গৌতম বুদ্ধ ) who became silent ( মৌন বুদ্ধদেব ) at 10 questions that were left unanswered ( দশ অকথনীয় প্রশ্ন ). This story ( গৌতম বুদ্ধের গল্প ) is really unbelievable. This life story ( বুদ্ধের জীবনের গল্প ) also includes here the Buddhist Philosophy in a very short span.

গৌতম বুদ্ধ (ছবি: ইন্টারনেট)


একবার ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন কিনা? প্রশ্নটি শুনে বিদ্যাসাগর মৃদু হেসে বলেছিলেন, ঈশ্বর যদি থাকেন, থাকুন না। তাকে আমার কোন দরকার বোধ হচ্ছে না। আবার ধর্ম সম্পর্কে বলেছিলেন, ধর্ম যে কি, মানুষের বর্তমান অবস্থায় তা জানার উপায় নেই এবং জানারও কোন দরকার নেই।

আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে একজন মহাজ্ঞানী মহাপুরুষ বেশ কিছু আধ্যাত্মিক প্রশ্ন সম্পর্কে যেরকম মনোভাব পোষন করেছিলেন, তার সাথে বিদ্যাসাগরের মনোভাব অনেকটাই মিলে যায়। আমি যার কথা বলছি, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন মহাজ্ঞানী মহাপুরুষ গৌতম বুদ্ধ, ইতিহাসের পাতায় যিনি বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক বলে অভিহিত হয়ে আছেন।
আর্যসত্য (ফটো : ইন্টারনেট)

অনেকে বলেন, বুদ্ধদেব প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্ম আসলে দুঃখবাদী ধর্ম, কারণ বৌদ্ধধর্মের মূলগত ভিত্তি এটাই যে, আমাদের এই জগত সর্বগ্রাসী দুঃখের অধীন। বুদ্ধদেবের সাধনার মূল লক্ষ্যই ছিল, এই জাগতিক দুঃখকষ্ট থেকে মানবজাতিকে মুক্তির পথের সন্ধান দেওয়া। গভীর তপস্যার বলে তিনি চারটি সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর উপলব্ধ এই চারটি মহান সত্যকে বলা হয় আর্যসত্য। তা, সেই চারটি আর্যসত্য হল:
১) এই জগত দুঃখময়।
২) এই দুঃখকষ্টেরও কারণ আছে।
৩) দুঃখ নিরোধ সম্ভব।
৪) দুঃখকষ্টের অবসানের জন্য সত্য পথের সন্ধান করতে হবে।

বুদ্ধদেব বললেন, দুঃখের নিবৃত্তির নামই হল নির্বান, অর্থাৎ দুঃখের অবসান ঘটানোই হল নির্বাণের পথ। তা, দুঃখের নিবৃত্তি, দুঃখের অবসান কিভাবে ঘটবে? তিনি বললেন, প্রবৃত্তির বিনাশে, তৃষ্ণার বিনাশে দুঃখের নিবৃত্তি, দুঃখের অবসান সম্ভব। আর এই কাজটি সহজে করার জন্য তিনি মানুষকে মুক্তিমার্গের সন্ধান দিলেন, মুক্তির পথের সন্ধান দিলেন। তিনি আটটি পথের কথা বললেন, যা আপনারা জানেন, অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে পরিচিত।

বলাবাহুল্য এই প্রসঙ্গে তিনি বললেন, তাঁর নির্দেশিত অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করতে গিয়ে ভক্তদের বা ভিক্ষুদের ঈশ্বরের শরণাপন্ন বা আত্মা-পরমাত্মার শরণাপন্ন হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ হিন্দু ধর্মে বলা হয়, ঈশ্বরের শরণাপন্ন হলে তিনি আমাদের সবকিছু উদ্ধার করবেন, অথবা খ্রিস্টান ধর্মে বলা হয়, প্রভু যীশুর কৃপা হলে মানুষ যন্ত্রনার হাত থেকে মুক্তি পাবে, অথবা ইসলামে বলা হয়, আল্লা বা পয়গম্বরের করুনায় সমস্ত পাপ বিনষ্ট হবে, বৌদ্ধদর্শন কিন্তু এই তত্ত্ব স্বীকার করেনা। সোজাকথায়, বৌদ্ধধর্ম কোন ঈশ্বর বা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। সেজন্য বৌদ্ধধর্মকে কিন্তু নিরীশ্বরবাদী এবং একই সাথে নৈরাত্ম্যবাদী, আত্মা যেখানে নেই, নৈরাত্ম্যবাদী ধর্ম বলা হয়।

যাইহোক, এখানেই বুদ্ধদেবকে জিজ্ঞাসা করা ten unanswered questions, দশটি অকথনীয় প্রশ্নের কথা উঠে আসে। 
এই রচনাটিকে ভিডিওতে দেখতে উপরের ভিডিওটিতে ক্লিক করুন।

একদিন গৌতম বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবনে বিহার করছিলেন। সে সময় একজন শিষ্য অস্থির হয়ে তার কাছে ছুটে আসেন। শিষ্যের নাম ছিল মালুঙ্ক্যপুত্ত, কোথাও কোথাও অবশ্য নামটি বলা হয়েছে মোগ্গলিপুত্ত। তা, তিনি বুদ্ধদেবকে জানালেন যে, তার মনে কতগুলো প্রশ্ন এসে তাকে বিচলিত করছে। তিনি প্রশ্নগুলি বুদ্ধদেবের কাছে রাখতে চান। বুদ্ধদেব সম্মতি প্রদান করলেন। তখন সেই শিষ্য তাঁকে দশটি প্রশ্ন করেছিলেন ---- সেই দশটি প্রশ্ন, যে প্রশ্নগুলোর উত্তর মহাজ্ঞানী বুদ্ধদেব কখনোই দেননি, বা বলা যেতে পারে, সেই প্রশ্নগুলির উত্তরে গৌতম বুদ্ধ মৌনব্রত পালন করেছিলেন। এখান থেকেই কিন্তু silence of Buddha কথাটির উদ্ভব। 

যাইহোক, প্রশ্নগুলি শুনলে আপনারা সহজেই উপলদ্ধি করতে পারবেন যে, সেই প্রশ্নগুলি মূলত বেশ জনপ্রিয় প্রশ্ন, বলা যায় popular common questions -- মানে এই প্রশ্নগুলো অহরহ মানুষের মনে আনাগোনা করে। বুদ্ধদেব কিন্তু এই প্রশ্নগুলির একটিরও উত্তর দেননি।

তাহলে চলুন, প্রশ্নগুলিকে একবার দেখে নেওয়া যাক। প্রশ্নগুলি তিনটি ক্যাটাগরিতে, তিনটি ভাগে ভাগ করে করা হয়েছিল।

প্রথম ক্যাটাগরি: জগত বিষয়ক:
১) জগত কি নিত্য?
২) জগত কি অনিত্য?
৩) জগত কি সসীম?
৪) জগত কি অসীম?

দ্বিতীয় ক্যাটাগরি: দেহ ও আত্মা বিষয়ক:
১) আত্মা ও শরীর কি এক?
২) আত্মা ও শরীর কি ভিন্ন?

তৃতীয় ক্যাটাগরি: নির্বাণ পরবর্তী অবস্থা বিষয়ক:
১) মৃত্যুর পর তথাগতের কি পুনর্জন্ম হয়েছে?
২) মৃত্যুর পর তথাগতের কি পুনর্জন্ম হয়নি?
৩) তথাগতের পুনর্জন্ম হওয়া বা না হওয়া -- উভয় কি সত্য?
৪) তথাগতের পুনর্জন্ম হওয়া বা না হওয়া -- উভয় কি অসত্য?

লক্ষ করে দেখুন, এই দশটি প্রশ্ন কিন্তু মূলত পাঁচটি প্রশ্নেরই বর্ধিত রূপ।
গৌতম বুদ্ধ (ফটো : ইন্টারনেট নেট)

এবার নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে, এই প্রশ্নগুলোকে কেন popular common questions বলা হয়, অর্থাৎ ঈশ্বর, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি আলোচনার সময় প্রায়ই মানুষজন এই প্রশ্নগুলিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে;  যেমন আত্মা আছে কি আত্মা নেই, ঈশ্বর আছে কিছু নেই, এই জগত সত্য না মিথ্যে ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম প্রশ্ন নিয়ে মানুষজন অহরহ  নাড়াচাড়া করে বলেই প্রশ্নগুলিকে বলা হয় popular common questions। 

প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা দরকার যে বৌদ্ধদের পালি ভাষায় লেখা প্রাচীন গ্রন্থে বুদ্ধদেবের অকথিত প্রশ্ন সংখ্যা যেখানে দশটি, সেখানে সংস্কৃত ভাষায় লেখা গ্রন্থে অকথনীয়ত প্রশ্নের সংখ্যা কোথাও কিন্তু ১৪টি, কোথাও বা ১৬টি।

যাইহোক, এবার আমরা আসবো বুদ্ধদেব যে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন না, মৌনব্রত পালন করলেন --- তার তাৎপর্যটা কি, তার ব্যাখ্যাটা কি -- সেই কথায়!

দেখুন বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধদেবের এই মৌনতার বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা হয়েছে। কোন কোন পন্ডিতমানুষ একথা বলেছেন যে, বুদ্ধদেবের এই নীরবতা আসলে অজ্ঞানতার প্রতীক অর্থাৎ বুদ্ধদেব এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতেন না, তাঁর কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর ছিল না। 

আবার পন্ডিত মহলের একাংশ একথাও বলেছেন যে, বুদ্ধদেব আসলে ঈশ্বর-আত্মা-জগত ইত্যাদির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিজেই যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। অর্থাৎ এই বিষয়গুলি আদৌ আছে কি নেই, তা নিয়ে তিনি যথেষ্ট দোদুল্যমান ছিলেন, তার মনে কোন প্রত্যয়, কোন আত্মবিশ্বাস ছিল না। সেজন্যই নাকি প্রশ্নগুলির উত্তর সরাসরি তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন, বা তিনি মৌন ছিলেন, যে মৌনতাকে বলা হয় সংশয়বাদের স্বীকৃতি।

কিন্তু পণ্ডিতদের এইসব মত সাধারণ মানুষের কাছে, এমন কি, সমালোচক-গবেষক বা দার্শনিকদের কাছে, গ্রহণযোগ্য হয়নি, কারণটি অত্যন্ত পরিষ্কার, সেটা হলো এই যে, বুদ্ধদেব একজন মহাজ্ঞানী পুরুষ, দীর্ঘ সাধনার ফলে তিনি মহাজ্ঞানে বোধিপ্রাপ্ত হয়েছেন, সর্বজ্ঞ হয়েছেন, সর্বদর্শী হয়েছেন; এবং অসাধারণ ভাবে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন বিষয় তিনি মানুষের সামনে রেখেছেন। মানুষ সেই ধর্মীয় উপাদানগুলিকে শুধু ভক্তির মাধ্যমেই নয়, যুক্তি বিচারের কষ্টিপাথরে যাচাই করে সেসব গ্রহণ করেছে, এবং বুদ্ধদেবের মৃত্যুর আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় পরে, আজও তা, সমাজে-সভ্যতার বুকে চিরবহমান আছে। সুতরাং ওই দশটি প্রশ্নের উত্তর বুদ্ধদেব জানতেন না, তার সীমাবদ্ধতা ছিল, এটা কখনোই হতে পারেনা।

তাহলে এবার স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন উঠছে যে, বুদ্ধদেব যদি প্রশ্নের উত্তরগুলি জানতেনই, তাহলে তিনি কেন বললেন না! 

এই প্রশ্নের উত্তরে বহু পন্ডিত মানুষ এ কথাই বলেছেন যে, বুদ্ধদেবের এই মৌনতা আসলে উদ্দেশ্যমূলক। তার উদ্দেশ্য ছিল এটাই বুঝিয়ে দেওয়া যে, ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণে এসব প্রশ্নের উত্তর নিষ্প্রয়োজন। অর্থাৎ তিনি যে নীতিমার্গো অনুসরণের কথা বলেছেন, তাঁর নির্দেশিত সেই পথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে এসব প্রশ্নের উত্তর কোন সমস্যার সমাধান করে না। সোজা কথায়, নির্বাণ লাভের ক্ষেত্রে এসব প্রশ্নের উত্তর জানাটা কখনোই জরুরী নয়, প্রয়োজনীয় নয়। তিনি বলেছিলেন:

“.... আমি একে অকথনীয় .. বলেছি, কারণ ... এর সম্বন্ধে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভিক্ষুচর্যা বা ব্রাহ্মচর্যের জন্য যোগ্য নয়। আবার নির্বেদ-বৈরাগ্য, শান্তি ... পরম-জ্ঞান ও নির্বাণপ্রাপ্তির জন্যও এই অকথনীয়ের আবশ্যকতাই নেই; তাই আমি এদের বলেছি অবক্তব্য।“ (দিক-দর্শন by রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
গৌতম বুদ্ধের সাথে বিদ্যাসাগর মত মিলে যায়। (ফটো: ইন্টারনেট)

আর এখানেই আমার মনে পড়ে যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কি করেন না – এই প্রশ্নের উত্তরে তিনিও একই কথা বলেছিলেন। তিনিও বলেছিলেন, কর্মের জগতে জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যেতে তার ঈশ্বর ধারণার কোন প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ঈশ্বর আছে কি নেই -- এই বিষয়টি তার কাছে নিষ্প্রয়োজন।

তা, এই হল বুদ্ধদেবের দশটি অকথনীয় প্রশ্ন, 10 Unanswered Questions ,এবং তার আলোচনা।
 
আজ বুদ্ধপূর্ণিমা । বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।


Copyright: The Galposalpo

তথ্যঋণ:
১) মহামানব বুদ্ধ By রাহুল সাংকৃত্যায়ন
২) বৌদ্ধদর্শন By রাহুল সাংকৃত্যায়ন
৩) অনাত্মাবাদী বৌদ্ধদর্শন-০৩ : বৌদ্ধমতে দার্শনিক সিদ্ধান্ত By রণদীপম বসু
৪) What are the ten questions that the Buddha did not answer? By DHARMAKAMI BUDDHIST SOCIETY
৫) করুণাসাগর বিদ্যাসাগর By ইন্দ্রমিত্র
৬) হরপ্পা ওয়ার্ড প্রেস ডট কম
৬) উইকিপিডিয়া




Comments

Popular posts from this blog

জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্যদেবী : বিয়ের গল্প / Jibanananda Das and Labanya Debi : Marriage Story

বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম : উত্থান-পতনের আশ্চর্য ইতিহাস / History : Vande Mataram by Bankim Chandra

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : প্রথম চুম্বন, মদ্যপান আর প্রেমের গল্প / Sunil Gangopadhyay : Story of First Kiss, Wine and Love