মৃনাল সেন ও রেবা : একটি মর্মস্পর্শী কাহিনী / Mrinal Sen and Reba : Sad Life Story

মৃণাল সেন ও রেবার কাহিনী (Sad story of Mrinal Sen and Reba ) সত্যিই বড় মন খারাপ করে দেয়। কাহিনীটি একই সাথে তামান্না সেতুরও (Story of Tamanna Setu) কাহিনী। সবচেয়ে বড় কথা কাহিনীটি একদিকে যেমন মর্মস্পর্শী তেমনি অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির (Story of Communal Harmony)একটি দুর্লভ দৃষ্টান্ত।

Mrinal Sen and Reba (Photo: Sahaman and Krittibas Magazine)

১৫০ বছরের পুরনো ওই বাড়িটি আজ আর নেই। বাড়িটিকে ভেঙ্গে দিয়ে গ্যাছে বড় বড় দানবের মত যন্ত্র, অথবা সময়। বাড়ির সাথে সাথে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গ্যাছে বাড়িটির ইতিহাস, এক বাস্তুভিটার জীবন্ত ইতিহাস। 

তবে এই বাড়িটির পিছনে সেই পুকুরটি আজও কিন্তু আছে, যে পুকুরের মধ্যে কোথাও ঘুমিয়ে আছে পরম মমতায় তৈরি করা একটি স্মৃতিসৌধ, একটা মঠ, সেই মঠের মধ্যেই কোথাও আজও অপেক্ষা করছে রেবা --- রেবা সেন --- রেবা সেন নামে সেই ছোট্ট একটি মেয়ে, যে কিনা দেশভাগের বছর দশেক আগে ওই পুকুরের জলে সবার অলক্ষ্যে ডুবে গিয়েছিল।

মাঝে মাঝে ওই পুকুরের পাড়ে এসে একা একা দাঁড়াতেন তামান্না সেতু। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন পুকুরের টলটলে জলের দিকে। কখনো কখনো তার মনে হতো আপনজনের অপেক্ষায় থেকে থেকে অভিমানী বালিকা রেবা সেনের চোখের জলে পুকুরটি যেন ভরে উঠেছে।
Reba and Mrinal Sen (Photo : Sahaman and Krittibas Magazine)

তামান্না সেতু সেই মুসলমান মহিলা যার শৈশব কেটেছে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সেই বাড়িটিতে। দেশভাগের সময় তামান্না সেতুদের কাছেই বাড়িটি বিক্রি গিয়েছিলেন ফরিদপুরের নামকরা অ্যাডভোকেট দীনেশ সেন, যিনি ফরিদপুর শহর ছেড়ে চিরতরে কলকাতায় চলে আসার সময় তাঁর  সেই বাড়িটির নতুন মুসলমান মালিককে বলেছিলেন, আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে, পাঁচ বছর বয়সী আমার ছোট মেয়ে রেবা, তার একটা স্মৃতিসৌধ আছে পুকুরের ধারে। সে বাড়ীর সবার ছোট, ঐ পুকুরের জলে ডুবে একদিন সে মারা যায়। পারলে স্মৃতিসৌধটি রক্ষা করবেন।

এরপর বছরের পর বছর গড়িয়ে চলে। একদিন রাস্তার ধারে, বাড়ির জমিতেই মসজিদ তৈরি হল। পাড়ার অনেক মুসলমান বেশ বিরোধিতা করলেন, কারণ একই বাড়িতে মসজিদের সাথে সাথে হিন্দুদের মঠের উপস্থিতি তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না, তারা চাইছিলেন মঠটিকে ভেঙে ফেলা হোক। কিন্তু তামান্নারা সেসব ধর্মীয় চাপকে তেমন পাত্তা দিলেন না। 

এদিকে পুকুরের পাড় ভাঙছে, স্মৃতিসৌধটি প্রায় তলিয়ে যায়।

লেখাটিকে ভিডিওতে দেখতে ও শুনতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

এমনই এক সময়ে একদিন কলকাতা থেকে বাড়িটির কাছে এসে শেষবারের মতো দাড়ালেন রেবা সেনের দাদা। শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে তিনি এসেছিলেন অতীতকে আরেকবার ছুঁয়ে দেখার প্রবল এক নেশায়, হয়তো বা এসেছিলেন ছোট বোন রেবা সেনের সঙ্গে দেখা করতে। 

সেদিন তিনি পুরো বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেন। অদ্ভুত এক নষ্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে বাড়িটির দেওয়াল বারবার ছুঁয়ে দেখছিলেন। বাড়ির উঠোনে এসে কান্না হাসি মেশানো গলায় বলেছিলেন, এই উঠোনে আমার বোনটা খেলত।

তারপর পুকুর পাড়ে এসে তিনি চুপটি করে দাঁড়িয়েছিলেন বহুক্ষণ। ছোট্ট টুকটুকে রেবা সেন তখন হয়তো তাকে বলছিল, দাদা সাতচল্লিশের দেশভাগের পর তোমরা আমাকে ছেড়ে, আমাকে একা ফেলে নিরুদ্দেশে চলে গেছো। কিন্তু দ্যাখো, দেশভাগ আমাকে কিছুতেই ভিটেছাড়া করতে পারেনি। আমি মরে গিয়ে বেঁচে আছি আজও।

ভারী চশমার পিছনে দাদার চোখ দুটো সেদিন হয়তো ভিজে উঠেছিল!

Mrinal Sen (Photo : Krittibas Magazine)

সেদিনের পর দাদা আর কখনো ফিরে আসেন নি সেই পুকুর পাড়ে, রেবা সেনের কাছে।

এর পরের ইতিহাস শুধুই হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। সেই বাড়িটিও আজ আর নেই, সেই স্মৃতিসৌধটিও আজ আর নেই।

রেবা সেনের দাদাও আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরে। তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন বাঙালি তথা ভারতবাসীর গর্ব, ভিন্ন ধারার প্রখ্যাত পরিচালক, চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন।

মৃণাল সেন ১৯২৩ সালের ১৪ই মে, আজকের মতোই এরকম একটি দিনে ফরিদপুরের সেই গ্রাম ঝিলটুলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৭ বছর সেখানে কাটানোর পর ১৯৪০ সালে পড়াশুনার জন্য তিনি ফরিদপুর থেকে কলকাতায় চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে এই কলকাতা শহরেই শুরু হয়েছিল চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তার অসামান্য এক নতুন জীবন।


উপরের লেখাটিকে ভিডিওতে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।


Copyright : The Galposalpo (YouTube Channel)

তথ্যঋণ: ১) তৃতীয় ভুবন  By মৃণাল সেন

২) মৃণাল সেন ও তার মৃত বোন রেবা By তামান্না সেতু

৩) সহমন ডট কম  ৪) উইকিপিডিয়া


Comments

Popular posts from this blog

জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্যদেবী : বিয়ের গল্প / Jibanananda Das and Labanya Debi : Marriage Story

বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম : উত্থান-পতনের আশ্চর্য ইতিহাস / History : Vande Mataram by Bankim Chandra

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : প্রথম চুম্বন, মদ্যপান আর প্রেমের গল্প / Sunil Gangopadhyay : Story of First Kiss, Wine and Love