উপেক্ষিত মৃণাল সেন : ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার / Mrinal Sen : The First Indian Political Filmmaker
এখানে আলোচিত হল : ১) মৃণাল সেন ও মৃণাল সেনের সিনেমা ( Mrinal Sen Movies) ২) প্রথাবিরোধী মৃণাল সেনের 'ভুবন সোম' ৩) সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ঘরানা ৪) মৃণাল সেনের কোলকাতা ট্রিলজী
মৃণাল সেন ও মৃণাল সেনের সিনেমা:
মৃণাল সেন ১৯২৩ সালের ১৪ই মে বর্তমানে বাংলাদেশের ফরিদপুরের গ্রাম ঝিলটুলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা দীনেশ সেন ছিলেন ফরিদপুরের নামকরা একজন অ্যাডভোকেট। মায়ের নাম সরযূবালা দেবী। আইনজীবী পিতা ও গৃহিণী মা -- দুজনেই পরোক্ষে যুক্ত ছিলেন রাজনীতিতে। সেজন্য ছোট থেকেই মৃণাল সেন ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন। ১৭ বছর ফরিদপুরে কাটানোর পর ১৯৪০ সালে পড়াশুনার জন্য তিনি ফরিদপুর থেকে কলকাতায় চলে আসেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সেই চল্লিশের দশকে তিনি আইপিটিএর (ইন্ডিয়ান পিপ্লস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হন। তবে মনে রাখতে হবে, তিনি কিন্তু কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পর তিনি সাংবাদিক, ওষুধ বিপণনকারী এবং চলচ্চিত্রে শিল্পে শব্দ-কলাকুশলী প্রভৃতি বিভিন্ন পেশায় সাময়িক ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই কলকাতা শহরেই শুরু হয়েছিল চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তার অসামান্য এক নতুন জীবন।
প্রথাবিরোধী মৃণাল সেনের 'ভুবন সোম' :
১৯৬৯ সালে তৈরি হয়েছিল একদম প্রথাবিরোধী একটি চলচ্চিত্র, নাম 'ভুবন সোম'। ছবিটিতে কনভেনশনাল সিনেমার ধারা উড়িয়ে দিয়ে, অর্থাৎ নায়ক-নায়িকা-ভিলেন এই গদ-বাঁধা গল্প আর তার ট্রিটমেন্টের ধারাটিকে সম্পূর্ণ সরিয়ে দিয়ে, ইউরোপিয়ান সিনেমার ধাঁচে সিনেমার ফর্ম নিয়ে অসাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছিল এই 'ভুবন সোম' চলচ্চিত্রটিতে; এবং সেই পরীক্ষা আশাতীতভাবে সফল হয়েছিল।
ছবিটি তৈরি হওয়ার সাথে সাথে ভারতবর্ষে নিউ ওয়েভ সিনেমা বা সিনেমার নবতরঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সোজা কথায়, কনভেনশনাল ভারতীয় সিনেমার পাশাপাশি প্যারালাল সিনেমা বা একটা সমান্তরাল সিনেমার ধারা জন্ম নিয়েছিল। ভারতীয় সিনেমায় সে এক অসাধারণ নবজাগরণ, আর এই নবজাগরণের গডফাদার ছিলেন আর কেউ নন, তিনি হলেন মৃণাল সেন, 'ভুবন সোম' ছবিটির পরিচালক। 'ভুবন সোম' ছবিটি তৈরি হবার পরেই নতুন সেই ধারায় সিনেমা করতে একে একে এগিয়ে এসেছিলেন শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনি, মণি কাউল এবং আরো অনেক সিনেমা পরিচালক।
'ভুবন সোম' ছবিটি মৃণাল সেনকে দেশ-বিদেশে পরিচালক হিসেবে বিপুল খ্যাতি এনে দিয়েছিল।
ছবিটি তৈরি হবার পর মৃণাল সেনকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর তিনি একের পর এক যেসব ছবি তৈরি করলেন, তা দেখে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নিলেন যে, ভারতীয় ছবিতে সত্যজিৎ-ঋত্বিক ঘরানার পাশাপাশি মৃণাল সেনের একটা নিজস্ব, স্বতন্ত্র এবং সমীহযোগ্য ঘরানা তৈরি হয়েছে।
# এই রচনাটিকে ভিডিওতে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ঘরানার তুলনামূলক রেখাপাত ও কলকাতা ট্রিলজি:
কেরিয়ারের মধ্যপর্যায়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দিকে তর্জনী:
তবে কলকাতা ট্রিলজি পর্বে আমরা যে রাগী মৃণাল সেনকে দেখতে পাই, সোচ্চার মৃণাল সেনকে দেখতে পাই, ১৯৮০ সালের পর থেকে তাকে কিন্তু আর সেই মেজাজে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং অন্য মৃনাল সেনকে আমরা দেখি, যিনি অনেক বেশি শান্ত নিরুচ্চার, অনেক বেশী ঋদ্ধ, পরিণত। আমরা দেখি, এই নতুন মৃণাল সেন রাষ্ট্রের দিকে তাঁর অভিযোগের তর্জনী আগের মতো আর তুলছেন না, সেটা ঠিকই, কিন্তু তিনি আঙ্গুল ঘুরিয়ে দিয়েছেন এবার নিজের দিকে, মধ্যবিত্ত মৃণাল সেনের দিকে, সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দিকে। এই সময় তিনি তৈরি করলেন 'আকালের সন্ধানে', 'খারিজ', 'খন্ডহর', 'মহাপৃথিবী' এবং 'জেনেসিস'-এর মত অসাধারণ সব ছবি। ছবিগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি বারবার মধ্যবিত্ত সমাজকে ঘাড় ধরে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন আয়নার সামনে, নগ্ন করে দিলেন মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা, স্বার্থপরতা, মধ্যবিত্তের নির্লজ্জতাকে।
#এই লেখাটিকে ভিডিওতে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
কেরিয়ারের শেষের দিকে ব্যক্তিমানুষের দিকে তর্জনী:
আবার তার কেরিয়ারের শেষের দিকে তিনি যে সমস্ত ছবি করলেন, সেই ছবিগুলোতে তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে নয়, একাকী ব্যক্তিমানুষকে প্রশ্ন করলেন। তিনি যেন উপলব্ধি করেছিলেন, প্রতিটি বিপ্লবী মানুষের শেষ এবং চুড়ান্ত বিপ্লব তার নিজেরই বিরুদ্ধে। সেই অনুভব থেকে, ব্যক্তি মানুষের একাকীত্ব, তার মানসিক বিপর্যয়, তার স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, তার আত্ম অনুসন্ধান -- সবকিছুকে নিয়ে তৈরি করলেন তাঁর অসাধারণ সব ছবি। 'অন্তরীণ', 'একদিন অচানক', 'একদিন প্রতিদিন', 'আমার ভুবন' -- এসব ছবিগুলিতে সমাজের ভেতর ব্যক্তির অস্তিত্বের ভারসাম্য নিয়ে তিনি অস্বস্তিকর অপ্রিয় প্রশ্ন তুলে দিলেন।
বাস্তবিকই মৃনাল সেনের মত আর কোন ভারতীয় পরিচালকের ছবিতে এত বিভিন্ন, বিচিত্র বিষয়ের সংঘাত ও সহাবস্থান কখনোই ঘটেনি। ফলে মাঝেমাঝেই ছবি তৈরীর পরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, স্টেটসম্যান পত্রিকায় তাঁর ‘আকাশকুসুম’ ছবিটিকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সাথে তাঁর তুমুল পত্রযুদ্ধ। তবে সেসব বিতর্ককে তিনি gladly accept করতেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, 'Truth attains a quality only when it becomes controversial'.
উপেক্ষিত মৃণাল সেন:
অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন, বাঙালি দর্শকদের অধিকাংশের কাছে মৃণাল সেন কখনোই কাছের মানুষ বা পছন্দের পরিচালক হয়ে উঠতে পারেন নি। তিনি যেন বরাবর রয়ে গেলেন উপেক্ষিত। বাঙালি সবসময় তার সম্পর্কে কম কথা বলে, কম আলোচনা করে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক প্রাবন্ধিক শমিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন : “দুর্ভাগ্য, নাকি ভাগ্যই বলবো মৃণাল সেনের, তিনি কোনদিন বাঙালির দেবকুলে স্থান পাননি।“
অথচ অফুরন্ত এই রোমান্টিক ব্যক্তিত্ব, ক্লান্তিহীন এই বিপ্লবী পরিচালকের কাছে আমরা, বাঙালি হিসেবে দায়বদ্ধ।
আশা করি, চলচ্চিত্র মাধ্যম নিয়ে উৎসাহী নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা মৃণাল সেনের সিনেমা, তাঁর সিনেমার দর্শন, তাঁর চলচ্চিত্রবিষয়ক বইপত্র থেকে শক্তি সাহস উৎসাহ সঞ্চয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন।
এই প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজ এই পর্যন্ত। দেখা হবে নতুন কোন বিষয়ে। ভালো থাকুন। নমস্কার।
উপরে লেখাটির ভিডিওতে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
Copyright : The Galposalpo ( YouTube Channel)
তথ্যঋণ:
১) তৃতীয় ভুবন
By মৃণাল সেন
২) কৃত্তিবাস ২০১৯
মৃণাল সেন বিশেষ সংখ্যা
৩) মৃণাল সেন এক উপেক্ষিত চলচ্চিত্রকার
By এবড়োখেবড়ো
৪) মৃণাল সেন ও তার মৃত বোন রেবা
By তামান্না সেতু
৫) গুরুচণ্ডালী ডট কম
৬) সহমন ডট কম
৭) উইকিপিডিয়া





Comments
Post a Comment