শ্রদ্ধার্ঘ্য : তরুণ মজুমদার : অসামান্য জীবনী / Tribute to Tarun Majumdar : Biography / Life Story
অবিভক্ত পূর্ববঙ্গের এক সাবেক ছোট্ট শহর, বগুড়া --- সেখানেই মধ্যবিত্ত এক ছাপোষা পরিবারে ১৯৩১ সালের ৮ই জানুয়ারিতে তাঁর জন্ম হয়েছিল। ছেলেবেলা কেটেছে সেই ছোট্ট শহরেই। সে সময়ে সেই শহরে দুটো সিনেমাহল ছিল। কলকাতা বা বোম্বের ছবি সেখানে বেশ চালানো হতো, সেসব ছবি তিনি বুঁদ হয়ে দেখতেন। সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার ক্ষেত্রে বাড়িতে কিন্তু বড়দের কোন বাঁধানিষেধ ছিল না। সেই সিনেমা হলগুলোতেই তিনি প্রথম চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেখেছিলেন। সেসব সিনেমা দেখতে দেখতেই নিজেরেই অজান্তে সিনেমার প্রতি তার একটা অদম্য টান তৈরি হয়েছিল।
১৯৪৫ সাল। দেশভাগের দুবছর আগেই মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি চলে আসেন এপার বাংলায়। কলকাতার সেন্ট পলস কলেজে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। সেন্ট পলস থেকে আই এস সি পরীক্ষায় পাশ করার পর, স্কটিশ চার্চ কলেজে তিনি কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলেন, এবং সেখান থেকেই গ্রাজুয়েশন করলেন।
#
এদিকে, পড়াশোনার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের প্রতি তার টান উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকল। একসময় মেট্রো সিনেমার গলিতে প্রায় রোজই যাতায়াত করে সাইক্লোস্টাইলে ছবির স্ক্রিপ্ট তৈরি করা মন দিয়ে শিখলেন। তারপরেই একদিন তিনি বাড়ির বড়দেরকে জানালেন, তিনি ছবির জগতে, সিনেমার লাইনে কাজ করতে চান।
মা-বাবা কিন্তু বাধা দিলেন না। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল বড়মামার কাছে, যিনি ছিলেন ফিল্মল্যান্ড নামে একটি কাগজের সম্পাদক। অবশেষে বড়মামারই সুপারিশে পার্কসার্কাসের কাছে একটি স্টুডিওতে ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টের অবজার্ভার হিসেবে তার কাজ করা শুরু হল, কিন্তু শুনলে অবাক হবেন যে, ক্যামেরার সঙ্গে ভালো করে পরিচয় হতে না হতেই চারপাঁচ দিন পরেই সেই কাজের ইতি ঘটল। কারণটা ছিল সোজাকথায় ইউনিয়নবাজি। সংস্থার সদস্য না হলে ওখানে কারো কোন জায়গা হবে না।
#
এরপরে তিনি আরেকটি কাজ পেলেন। সিনেমার বিজ্ঞাপন সংস্থার শিক্ষানবিশের কাজ। সেখানে ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের পথিক ছবির বিজ্ঞাপনের জন্য একটা ব্যতিক্রমী খসড়া তৈরি করলেন সেই তরুণ। অলৌকিক ভাবেই সেই খসড়াটি চোখে পড়ে যায় পরিচালক দেবকীকুমারের।
জীবনপুরের সেই তরুণ পথিকের জীবনের মোড় যেন ঘুরতে শুরু করলো। দেবকীকুমারের সৌজন্যে সে যুগের প্রখ্যাত অভিনেত্রী কানন দেবীর প্রযোজনা সংস্থা, শ্রীমতী পিকচার্সে তিনি শিক্ষানবিশের চাকরি পেয়ে গেলেন। সেখানেই আলাপ হলো শ্রীমতি পিকচার্সের দুই সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট দিলীপ মুখোপাধ্যায় আর শচীন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আর সেই আলাপ থেকেই সূত্রপাত 'যাত্রীক' গোষ্ঠীর। সেই ‘যাত্রীক’ গোষ্ঠীর হাত ধরেই ছবি পরিচালনার জগতে পদার্পণ ঘটে সেই যুবকের। সিনেমাপাড়ায় প্রবেশ করলেন সেদিন যে যুবক, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন তরুণ মজুমদার।
#
সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী ছবি দেখে তিনি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। কলকাতা মহানগরের বুকে বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন এক মিছিলে, সেই মিছিলে তাঁর বুকে ছিল একটি ব্যানার, যেখানে লেখা ছিল 'পথের পাঁচালী দেখুন।'
সংসার সীমান্তে ছবির জন্য তিনি নির্মাণ করেছিলেন এমন এক আস্ত যৌনপল্লী, যা দেখে সবার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। আজকের এই ফিল্মসিটির যুগে দাঁড়িয়ে সেই সময়ের এমন আস্ত একটা সেট কল্পনা করা বাস্তবিক অর্থেই অসম্ভব। কিন্তু তা সত্যিই ঘটেছিল।
বিমল কর থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় --- তাদের অনেক সাহিত্যকীর্তিকে বড়পর্দায় তিনি তুলে ধরলেন। পল্লীবাংলার সহজ-সরল প্রাণবন্ত চালচিত্র তার ছবিতে বেশিরভাগ সময় উঠে আসতে থাকলো। যৌথ পরিবারগুলো যেখানে ক্রমশ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, সেখানে তিনি সবাইকে একসাথে বেঁধে রাখার গল্প বললেন। যেখানে ভালোবাসা নিয়ে অবিশ্বাসের প্রশ্ন সন্দেহের প্রশ্ন ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করেছে, সেখানে তিনি নিটোল প্রেমের গল্প শোনালেন।
আর ছবিতে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের এমন অপূর্ব প্রয়োগ করলেন যে, বাঙালি দর্শক মাত্রেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেই চিত্রায়নের সাথে সাথে খুব সহজেই নিজেদেরকে রিলেট করতে সক্ষম হলেন।
সে সব দিক থেকে দেখলে একটা কথা বলাই যায় যে, তরুণ মজুমদার বা তার সহযাত্রীরা তপন সিংহ, রাজেন তরফদার প্রমুখেরা ভারতীয় সিনেমায় অনেক বিষয়েই ছিলেন অগ্রপথিক। সেই ষাট-সত্তরের দশকে ভারতীয় সিনেমার যে পর্ব তিনি তৈরি করতে শুরু করেছিলেন, তাত্ত্বিকদের মতে সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল বাংলা সমান্তরাল ছবির পথচলা।
অবশ্য তিনি যখন ছবি করছিলেন, তখন তিনি সেসব মোটেও ভাবেননি। তার লক্ষ্য ছিল একটাই, ভারী ক্যামেরা আর ট্রলির কারিকুরি দিয়ে আর যাই হোক ছবিকে শেষপর্যন্ত ছবি হিসাবে দাঁড় করাতেই হবে। তার সিনেমার জাদুতে তখন মুগ্ধ আট থেকে আশির দর্শকরা। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ প্রমূখ পরিচালকদের মত সমালোচকদের বিপুল সাড়া না পেলেও তার ছবি মানেই বক্সঅফিসে একের পর এক হিট ছবি। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল জমানার মধ্যেও তিনি তখন চিরতরুণ এক ব্যতিক্রমী পরিচালক।
#
কেরিয়ারের শুরুতেই যাত্রিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে যৌথ ভাবে মোট চারটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। সে দিক দিয়ে প্রথম ছবি ছিল ১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া উত্তমসুচিত্রাকে নিয়ে ছবি ‘চাওয়া পাওয়া'
১৯৬০ সালে তৈরি হয় সুচিত্রা সেনের দ্বৈতভূমিকা সম্বলিত ছবি ‘স্মৃতিটুকু থাক’।
১৯৬৩তে বাকি দুটি ছবি মুক্তি পেল পলাতক ও কাঁচের স্বর্গ।
এরপর ১৯৬৫ সাল থেকেই তরুণ মজুমদার সম্পূর্ণ এককভাবে নিজেই সিনেমা পরিচালনা করতে শুরু করলেন।
সে দিক দিয়ে তার প্রথম ছবি ১৯৬৫ সালে মুক্তি পেল ‘আলোর পিপাসা'। এরপর তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে ছিল:
১৯৬৭ : বালিকা বধূ
১৯৭১ : নিমন্ত্রণ
১৯৭৩ : শ্রীমান পৃথ্বীরাজ
১৯৭৪ : ঠগিনী
একই বছরে অর্থাৎ ১৯৭৪এ ফুলেশ্বরী
১৯৭৫ : সংসার সীমান্তে
১৯৭৮ : গণদেবতা
১৯৮০ : দাদার কীর্তি
১৯৮২ : খেলার পুতুল
১৯৮৫ : ভালোবাসা ভালোবাসা
১৯৮৮ : আগমন
১৯৯০ : আপন আমার আপন
২০০৩ : আলো
এবং
২০০৭ : চাঁদের বাড়ি।
২০১৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস দূর্গেশনন্দিনী অনুসারে একটি ধারাবাহিকও তৈরি করেছিলেন।
লিখেছেন দুখন্ডে স্মৃতিচারণামূলক বই যার নাম ‘সিনেমা পাড়া দিয়ে'।
চলচ্চিত্র জগতে তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন চার চারটি জাতীয় পুরস্কার। যে ছবিগুলো জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে সেই ছবিগুলি হল: কাজের স্বর্গ, নিমন্ত্রণ, গণদেবতা এবং অরণ্য আমার।
১৯৯০ সালে তিনি পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন।
#
এভাবেই বাঙালি দর্শকদের সাথে কাটিয়ে দিলেন প্রায় ৫০টি বছর। তবে সমালোচকরা বলেন যে তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই বড় বেশি মেলোড্রামাটিক, চড়া পর্দায় যেন আটকে থাকে আবেগ। ঘটনায় অতি নাটকীয়তার ছড়াছড়ি। তরুণ মজুমদার এই অভিযোগ শুনে যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ হল এটাই যে, তিনি জানেন যে সমালোচকরা তার ছবিকে অতিনাটকীয় বলেন, কিন্তু তিনি দেখতে চান যে, দর্শকরা কি বলেন। তাঁর ছবির সঙ্গে দর্শকরা একাত্ম হোন বলেই তো, দর্শকরা তার ছবি দেখতে আসেন। সুতরাং সমালোচকরা অতিনাটকীয় বললেও তার কাছে দর্শকদের প্রতিক্রিয়াই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে এই প্রখ্যাত পরিচালক নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে বামপ্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে ভোট দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন জানিয়ে চিঠিও লিখেছিলেন। বলাবাহুল্য, বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায় ছিলেন তার সহধর্মিনী। তবে শোনা যায়, তাদের দাম্পত্য জীবন সফল ছিল না, বহুবছর ধরে তারা কখনো একসাথে ছিলেন না।
তা, চিরটাকাল, সমালোচক নয়, সাধারণ বাঙালি দর্শককেই যিনি প্রাধান্য দিয়ে এসেছিলেন, বাঙালি মানসে যিনি অবলীলায় ভালোবাসার এক চিরস্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছিলেন, সেই প্রখ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদার আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। গতকাল, ৪ঠা জুলাই, এস এস কে এম হাসপাতালে সকাল ১১টা১৭ মিনিটে বিরানব্বই বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হয়েছেন।
তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।
নমস্কার।
কপিরাইট : দ্য গল্পস্বল্প
Comments
Post a Comment