সেলিম আলি : অসামান্য পক্ষী বিজ্ঞানীর জীবন কাহিনী / Bird Lover Salim Ali Life Story
সেলিম আলি : অসামান্য পক্ষী বিজ্ঞানীর জীবন কাহিনী / Salim Ali Life Story
তা, ভারতের সেই পক্ষীবিশারদ, শুধু ভারতের নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের সেই বিখ্যাত পক্ষীবিশারদ হলেন সালিম আলি। সালিম আলি নাম হলেও তিনি সেলিম আলি বলেই সবার কাছে সুপরিচিত।
আজ ১২ই নভেম্বর, আজকের মতই একটি দিনে ১৮৯৬ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আজ তার সম্পর্কেই কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করব।
#
খুব ছোটবেলায় এয়ারগান হাতে পাখি শিকার করতে গিয়ে সেলিম আলি চড়ুই পাখির প্রেমে পড়েছিলেন। সেই প্রেম তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মামা আমিরুদ্দিন তৈয়বজী এবং বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সৌজন্যে তিনি কিভাবে পাখি শিকারি থেকে পাখি প্রেমিক হয়ে উঠেছিলেন --- আপনারা সেই গল্পটি সকলেই জানেন। একজন সাধারণ পাখি-পর্যবেক্ষক থেকে বিশ্বের প্রবাদপ্রতিম একজন পক্ষীবিশারদ -- journey from a bird watcher to an ornithologist –এই জার্নি কিন্তু এক কথায় মহাকাব্যিক --- indeed an epic journey.
আমার মনে পড়ছে, ১৯৩০ সালের কথা। সদ্য তিনি জার্মানিতে এক বছর পক্ষী বিজ্ঞানের উচ্চতর শিক্ষা লাভ করে দেশে ফিরেছেন। জার্মানিতে যাওয়ার আগে বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে তিনি যে গাইডের কাজটি করতেন, জার্মানি থেকে ফিরে এসে সেই কাজটি আর পেলেন না। খরচ কমানোর জন্য তিনি বম্বে শহর থেকে অনেক দূরে কিহিম নামে একটি অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করলেন। সেখানে সংসার চালাচ্ছেন স্ত্রী তাহমিনা।
সেলিম আলির তো নিজের কোন ইনকাম ছিল না, তখন তিনি কি করছেন? সারাদিন ধরে যেখানে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন, তার আশেপাশে যে নিবিড় গাছগাছালি, তারই মধ্যে মাটি থেকে ১০-১২ ফিট উপরে একটা মাচা তৈরি করে সারাদিন ধরে তিনি লক্ষ্য করছেন বাবুই পাখির বাসা। যা দেখছেন, তাই খুঁটিনাটিসহ তিনি তার নোট বইতে টুকে রাখছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, পুরুষ বাবুই পাখিরা অর্ধেক বাসা বানিয়ে অপেক্ষা করে। একসময় অনেক মেয়ে বাবুই পাখি সেখানে আসে। তারা সেই অর্ধসমাপ্ত বাসাগুলিকে ঘুরে ঘুরে দেখে নিয়ে নিজেদের পছন্দমত বাসাকে একে একে বেছে নেয়। মেয়ে বাবুই পাখিদের বাসা পছন্দ হয়ে গেলে পুরুষ বাবুইরা তারপর সেই বাসা তৈরি করার কাজটা সম্পূর্ণ করে। আর যদি কোন মেয়ে বাবুই পাখি কোন বাসাকে পছন্দ না করে, তাহলে পুরো প্রচেষ্টাটাই বিফলে যায়। পুরুষ বাবুই পাখি পুরনো সেই অর্ধসমাপ্ত বাসাকে ত্যাগ করে আবার নতুন করে বাসা বানাতে শুরু করে।
সেলিম আলী সারাদিন ধরে সেই বাবুই পাখিদের পর্যবেক্ষণ করে তাদের ক্রমান্বয়ী বহুগামী প্রজনন রীতি বা sequential polygamy এই অদ্ভুত আশ্চর্য তথ্য তিনিই প্রথম আবিষ্কার করলেন। তার এই নতুন আবিষ্কারের সমস্ত কিছু একেবারে systematic ভাবে তিনি তাঁর ডায়েরিতে টুকে রাখলেন।
সেলিম আলি : অসামান্য পক্ষী বিজ্ঞানীর জীবন কাহিনী / Salim Ali Life Story ---- এই আলোচনাটিকে ভিডিওতে দেখতে নিচের ভিডিওতে ক্লিক করুন :
#
আমাদের মনে রাখতে হবে যে ভারত স্বাধীন হবার আগে ইংরেজরা, তারা কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন জায়গায় পাখির সন্ধান করতেন। পাখিদের নিয়ে তথ্যভাণ্ডার তৈরি করার প্রবণতা তাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু তাদের সেই পাখি পর্যবেক্ষণ ছিল নিতান্তই যান্ত্রিক। তারা শুধুমাত্র পাখির প্রকারভেদ, পাখিকে stuff করা ইত্যাদি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন। পাখিদের জীবন, পাখিদের চালচলন, পাখিদের বাসস্থান, পাখিদের বিভিন্ন কলকাকলি, পাখিদের প্রজনন --- সেসব নিয়ে তারা একদমই মাথা ঘামাতেন না। সেলিম আলি কিন্তু সেই কাজটি করেছিলেন সুচারুভাবে। আর এখানেই তাঁর মৌলিকত্ব, তাঁর বিশেষত্ব।
রাজা মহারাজাদের অনুমতি নিয়ে দিনের পর দিন তিনি পাহাড়ে, জঙ্গলে, নদীর চরে তাবু খাটিয়ে পাখি পর্যবেক্ষণ করেছেন। পাখিদের জীবনযাপন, তাদের বাসা বাধা, তাদের চলাফেরা ---- এসব পর্যবেক্ষণের টানেই পাহাড়, জঙ্গল, দুর্গম-দুস্তর পথ, হিংস্র জীবজন্তু, সাপখোপ ---- কোন কিছুর তোয়াক্কা তিনি করেননি। জলে-কাদায় কাটাতে হয়েছে তাঁকে দিনের পর দিন।
আপনারা শুনলে আশ্চর্য হবেন যে, কখনো কখনো ঝোপের ঘেরাটোপে তিনি বসে থেকেছেন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত, অবিচল ধৈর্য নিয়ে একদম স্ট্যাচু হয়ে তিনি সেখানে অপেক্ষা করেছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। প্রতিমুহূর্তে তাকে সতর্ক থাকতে হয়েছে যাতে কোনভাবেই পাখিরা তাঁর অস্তিত্ব টের না পায়।
জীবনও বিপন্ন হয়েছে বহুবার। ডাকাতের হাতে পড়েছেন, বুনো হাতির কবলে পড়েছেন। কোন কোন বিশেষ পাখির হদিস করার জন্য জীবন হাতে করে খাড়া পাহাড়েও তিনি চড়েছেন।
প্রসঙ্গত, সেই ভয়ংকর ঘটনাটির কথা মনে পড়ে যায়। একবার লিপুলেখ গিরিপথে পাখির দিকে নজর রেখে পেছন দিকে তিনি হাঁটছেন। পিছন দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ গড়িয়ে পড়া পাথরের শব্দে পেছন ফিরে দেখলেন, একেবারে খাদের কিনারায় এসে তিনি দাঁড়িয়েছেন। আরেকটু হলেই অতল খাদে পড়ে তাঁর প্রাণটাই চলে যেত। একেবারে শেষ মুহূর্তে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর মুখ থেকে তিনি ফিরে এসেছিলেন সেদিন।
তবে সেলিম আলির পাখি দেখার কাজ সাধারণ মানুষের চোখে অদ্ভুত মনে হলেও, অনেক সমঝদার মানুষের তিনি সহযোগিতা পেয়েছিলেন। একবার কি হলো, কেরালার কোচিনের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মালগাড়ি যাবার সময় হঠাৎ সেই মালগাড়িটি জঙ্গলের মধ্যে থেমে গিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে এসেছিলেন ড্রাইভার, হাতে তার মরা একটি বাজপাখি। ওয়াগনে মজুদ রাখা মুরগির বাচ্চাদের উপর ছোঁ মারতে গিয়ে সেই বাজপাখিটি মারা পড়েছিল। ড্রাইভার শুনেছিলেন, সেই ঘন জঙ্গলের মধ্যে তাবু ফেলেছেন পক্ষীপ্রেমিক সেলিম আলী। দুর্গম সেই জঙ্গলের মধ্যে তাঁবুতে উপস্থিত হয়ে তিনি পাখিটিকে সেলিম আলীর কাছেই অর্পণ করলেন। পাখিটিকে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে সেলিম আলি বলেছিলেন, পাখিটি দুর্লভ প্রজাতির একটি বাজপাখি। গবেষণার কাজে এই মরা পাখিটি তাঁর অনেক উপকার করবে। ড্রাইভার বুঝেছিলেন, পাখিটিকে তিনি একদম সঠিক মানুষের কাছেই অর্পণ করেছেন।
#
পাখিদের টানেই সেলিম আলি হায়দ্রাবাদ, ত্রিবাঙ্কুর, কোচিন, ইন্দর, ভূপাল, হিমাচল প্রদেশের গাড়োয়াল, কুমায়ুন, এমন কি পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তিব্বত, ভূটান ---- অর্থাৎ পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে তিনি পাখিদের উপরে অসামান্য বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার কাজ চালিয়েছিলেন। লিখেছেন বহু প্রবন্ধ নিবন্ধ।
১৯৪১ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর বিখ্যাত বই ‘দ্য বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস’। শুনলে অবাক হবেন যে, সেই বইটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই প্রায় ৪৬ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। তবে সেলিম আলীর সব থেকে বড় কৃতিত্ব হল ১০ বছর ধরে তার লেখা ১০ খন্ডে এক অত্যাশ্চর্য বই, যার নাম “হ্যান্ডবুক অফ দা বার্ডস অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান।“ বলাবাহুল্য, এই বিশাল কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন পক্ষী বিশারদ এস ডিলন রিপ্লে।
রাজস্থানের বিখ্যাত ভরতপুর বার্ড স্যাংচুয়ারি ছিল কিন্তু তারই প্রতিষ্ঠিত।
এখানে একটা কথা বলা দরকার যে, পাখি আর প্রকৃতিপ্রেমের বাইরে মোটরসাইকেল ছিল কিন্তু তাঁর ভীষণ প্রিয়, তাঁর আরেক প্যাশন। নিত্যনতুন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল সংগ্রহ করা, সেসব মোটরসাইকেলে চড়ে পক্ষী অভিযানে বেরিয়ে পড়া -- এসব ছিল তাঁর জীবনের দুর্দান্ত অদম্য সব নেশা।
১৯৫০ সালে সুইডেনে যে আন্তর্জাতিক পক্ষীতাত্ত্বিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই সম্মেলনে একমাত্র তিনিই ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। শুনলে আশ্চর্য হবেন যে, সেই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি জাহাজে করে তার প্রিয় বাইক, 'সানবিম' -- সেই প্রিয় বাইকটিকে নিয়ে তিনি সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল একটাই, সেই বাইকে করে গোটা ইউরোপ তিনি চষে বেড়াবেন। বলাবাহুল্য, তাঁর সেই স্বপ্ন বহুলাংশে সফল হয়েছিল।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সারা জীবন ধরে তিনি তাঁর অসাধারণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছিলেন বহু পুরস্কার ও সম্মান। সেই সব পুরস্কার ও সম্মানের মধ্যে অন্যতম একটি সম্মান ছিল এটাই যে, তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি ১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ অর্নিথোলজিস্টস ইউনিয়ন কর্তৃক ইংরেজ না হয়েও স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। ভারত সরকার তাঁকে ১৯৫৮ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭৬ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানে সম্মানিত করে।
১৯৭৬ সালেই পরিবেশ বিষয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুস্কার পল গেটি অ্যাওয়ার্ড - সেই পুরস্কার তিনি লাভ করেছিলেন।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল সেলিম আলীর আত্মজীবনী "দ্য ফল অফ এ স্প্যারো", বাংলায় যে অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে “চড়াই উতরাই” নামে, অনুবাদ করেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তা সেই আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছিলেন:
”অস্তিতপঞ্চক সভ্যতার দ্রুতবেগের এই যান্ত্রিক যুগের কোলাহলময় ডামাডোল থেকে আমার মুক্তির রাস্তা হল পাখি দেখা।“
সেই মুক্তির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই কবেই যেন তিনি হয়ে গেলেন ভারতের বার্ডম্যান।
১৯৮৭ সালের ২০শে জুন একানব্বই বছর বয়েসে ভারতের এই বার্ড ম্যান সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চিরতরে উড়ে গেলেন দিকশূন্যপুরের দিকে।
আজ তাঁর জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রণাম।
.......................................................................
সেলিম আলি : অসামান্য পক্ষী বিজ্ঞানীর জীবন কাহিনী / Salim Ali Life Story ----- এই আলোচনাটিকে ভিডিওতে দেখতে নিচের ভিডিওতে ক্লিক করুন:
1. চড়াই-উতরাইয়ের কথা : জন্মদিনে পক্ষীবিদ সালিম আলী By ডঃ মাল্যবান চট্টোপাধ্যায়
2. নির্বাচিত জীবনী সমগ্র By পৃথ্বীরাজ সেন
3. সববাংলায়
4. আনন্দবাজার পত্রিকা
5. Wikipedia
Copyright: The Galposalpo
Date: 12 November, 2022
Comments
Post a Comment