আব্বাসউদ্দিন আহমেদ : অসামান্য শিল্পীজীবনের গল্প / Abbasuddin Ahmed Unknown Life Story

১৯২৯ সাল। ব্রিটিশ ভারতের রংপুর জেলা। সেই জেলার অন্তর্গত চিকনমাটি গ্রামে এক বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। গ্রামের ফজিলুদ্দীন সরকারের বড় মেয়ে বেগম লুৎফুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হলো কোচবিহার জেলার এক বিখ্যাত লোকসংগীত শিল্পীর সঙ্গে।

বিয়ের রাতে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। সে রাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন শিল্পীর কলকাতার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব। ছিলেন বন্ধু তকরিম আহমেদ, যিনি খুব ভালো সেতার বাজাতে পারতেন। তা, বিয়ের পর অতিথি, পাড়া-প্রতিবেশীদের অনুরোধে, যার বিয়ে, সেই বিখ্যাত লোকসংগীত শিল্পীর গানের অনুষ্ঠান শুরু হল।

অনুষ্ঠানে যেইনা তক্রিম আহমেদ তার সেতারে টুংটাং আওয়াজ তুলেছেন, অমনি আশেপাশের রক্ষণশীল মুসলিমরা তুমুল আপত্তি জানালো। মুসলমানের বিয়েবাড়ি -- এখানে গান-বাজনা, যন্ত্রসংগীত এসব কেন! এসবের তো কোন সামাজিক প্রচলন নেই।

আচমকা সেই বাধায় কলকাতার বন্ধু-বান্ধবরা বেশ মন:ক্ষুন্ন হলেন। আর বন্ধুদের অপমানে, সদ্য বিয়ে করলেন যে লোকসংগীত শিল্পী, তিনি ভীষণ ক্ষিপ্ত হলেন। গানের অনুষ্ঠানে গন্ডগোলের সময়, তিনি সবার অলক্ষ্যে, কাউকে কিছু না বলে শ্বশুরবাড়ি থেকে সেই রাতে নিঃশব্দে বেরিয়ে চলে যান।

সে রাতে ভীষণ ঝড় হয়েছিল। সারারাত ধরে সেই ঝড়জলের মধ্যে বর কোথায় বর কোথায় বলে সবাই খোঁজাখুঁজি করেছিল, কিন্তু বরকে কোথাও পাওয়া গেল না। অবশেষে ভোরবেলা তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল। বিয়ে বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটি হাইস্কুলে। সারারাত বাইরের ঝড় আর নিজের মনের মধ্যে ঝড় --- এই দুই ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে করে ভোরের দিকে টেবিলের উপরে তিনি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর প্রতিবাদ করার ধরনটাই ছিল এই রকম। নিঃশব্দ, নীরব প্রতিবাদ।

কোচবিহারের এই বিখ্যাত লোকসঙ্গীতশিল্পীকে নিশ্চয়ই আপনারা চিনতে পেরেছেন, তিনি হলেন বিখ্যাত আব্বাসউদ্দিন --- আব্বাসউদ্দিন আহমেদ। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৯০১ সালের ২৭শে অক্টোবর কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহাকুমার বলরামপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

আব্বাসউদ্দিনের কথা মনে পড়লেই তাঁর বিখ্যাত গানগুলির কথা মনে পড়ে যায়। যে গানগুলি কোনদিনই পুরনো হবে না, সেই গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ১) মাঝি বাইয়া যাও রে ২) নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে ৩) প্রেম জানে না রসিক কালাচান ৪) আল্লা মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই ৫) ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে

আসলে তার জনপ্রিয় গান এত অজস্র যে, এভাবে উল্লেখ করা কখনই সম্ভব নয়। পল্লীগীতি, স্বদেশী গান, ইসলামী গান উর্দু গান, আধুনিক গান ----- সব ক্ষেত্রেই তার মৌলিকতা এবং সাফল্য অকল্পনীয়। আমার মনে পড়ছে, তার ছোটবেলার কথা।

#
কুচবিহারের তুফানগঞ্জ স্কুলে উচ্চ প্রাইমারি পরীক্ষা দিয়ে তিনি বাড়িতে এসেছেন। বাড়িতে মানে কুচবিহার জেলারই তুফানগঞ্জ মহাকুমার বলরামপুর গ্রাম। বিকেলে মাঠে যখন তিনি বন্ধুদের সাথে খেলছিলেন, তখনই এক বন্ধু এসে জানালো, আব্বাস তোদের বাড়িতে কলের গান হচ্ছে। সে কথা শুনেই আব্বাসউদ্দিন দৌড়ে চলে এসেছিলেন বাড়িতে। তিনি তো ছোট থেকেই গান বলতেই পাগল তা সে যাত্রাপালারই গান হোক, আর মহরমের মর্সিয়া গানই হোক। গান তাকে চুম্বকের মত সবসময় টানে।

তা, সেদিন তিনি বাড়িতে এসে দেখলেন, একটা লোক বাড়ি বাড়ি কলের গান শোনাচ্ছে, বিনিময়ে দুসের, একসের চাল, বা পয়সা, যে যা দেয় --তাই নিচ্ছে। আব্বাসউদ্দিন তো ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সত্যি সত্যিই তো কলের ভেতর থেকে তো গান বেরিয়ে আসছে! তিনি লোকটাকে বললেন, খুলে দেখাও তো, ভেতরে কে গান গাইছে। লোকটা বলল, চাল নিয়ে এসো। আমি দেখাচ্ছি ভিতরে কে গায়।
আব্বাসউদ্দিন মহাউল্লাসে বাড়ির ভেতর থেকে চাল নিয়ে আসলেন। লোকটা যন্ত্র খুলে দেখালো, না আছে লোক, না আছে কেউ। লোকটা বলল, ভেতরে কোন লোক নেই খোকা, এই যে কুকুর মার্কা শ্লেট, মানে এই কালো রেকর্ডখানা দেখতে পাচ্ছ না, এই রেকর্ডের উপরে এই ছোট্ট সুই মানে এই পিনটা লাগিয়ে দিলেই দ্যাখো, কি সুন্দর গান হয়।

আব্বাসউদ্দিন সেই কলের গান, গ্রামোফোন রেকর্ডের সেই গান তিনি জীবনে কখনো ভোলেন নি। গানটি ছিল: “বুড়ি তুই গাঁজার জোগাড় কর। ওলো তোর জামাই এলো দিগম্বর। গানটি গিয়েছিলেন সে যুগের বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা চিত্তরঞ্জন গোস্বামী।

সেদিন কিন্তু আব্বাসউদ্দিন কখনোই ভাবেননি যে, একদিন তিনিই কলের গান গাইবেন, গ্রামফোন রেকর্ডে গান গেয়ে বাংলার মানুষকে চমকে দেবেন।
সেই ঘটনার অনেক বছর পরে, গানের টানেই ১৯৩১ সালে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। ছোটবেলায় কলের গান শুনে তিনি অবাক হয়েছিলেন। আর এই কলকাতাতেই তিনি গাইলেন তার প্রথম কলের গান। হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন রেকর্ডে (এইচ এম ভি-তে) তিনি গাইলেন শৈলেন রায় এবং ধীরেন দাসের লেখা গান। গান দুটি ছিল যথাক্রমে: ১) স্মরণ পারের ওগো প্রিয় এবং ২) কোন্ বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে গো

আপনারা জানেন যে, গানের জগতে তাঁর কখনোই কোন ওস্তাদি তালিম ছিল না। গান শুনে শুনেই তিনি গানের সুর তুলতেন। নিজের প্রতিভাবলে, সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় তিনি গান গাওয়াকে রপ্ত করেছিলেন। অবশ্য কলকাতায় এসে পরে তিনি ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁ-য়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন।

কৈশোর থেকেই তিনি রংপুর এবং কুচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গান, ক্ষীরল গান, চটকা গান, জারি গান, সারি গান, ভাটিয়ালি গান, মর্সিয়া গান, পালা গান ইত্যাদি গান গেয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
(প্রসঙ্গত বলে রাখি, এসব গান সম্পর্কে আমার তেমন কোন কিন্তু সুস্পষ্ট কোন ধারণা নেই। আমি গানের জগতের লোক নই। আপনারা কমেন্টে যদি কেউ এসব গান নিয়ে প্রশ্ন করেন, ক্ষীরল গান কি, বা চটকা গান কি ইত্যাদি প্রশ্ন যদি কেউ করেন, আমি কিন্তু চট করে উত্তর দিতে পারবো না। আমাকে ওই অনেকের মতই নেট সার্চ করে এসে উত্তর দিতে হবে। সুতরাং আমি বলব, আপনাদের এইসব গান সম্পর্কে কোন তথ্যের দরকার হলে, প্লিজ, একটু নেট সার্চ করে নেবেন, অথবা কোন বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করবেন।)

#
লেখাপড়ায় আব্বাসউদ্দিনের প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল বলরামপুরের ছাত্রবৃত্তি স্কুলে। সেখান থেকে কিছুদিনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন কুচবিহার জেলা শহরের জেনকিন্স স্কুলে। সেই স্কুল ভালো না লাগায় পরবর্তী সময়ে ভর্তি হলেন তুফানগঞ্জ স্কুলে। তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য তা হলো, তিনি কিন্তু প্রত্যেক ক্লাসে পড়াশুনায় এবং সংগীতে বরাবর প্রথম স্থান অধিকার করতেন।

ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করার পর ভর্তি হলেন কোচবিহার কলেজে। সেখানে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর তিনি লখনৌ শহরের মরিস মিউজিক কলেজে পড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বাবা অত দূরে তাঁকে পাঠাতে রাজি হননি। বাধ্য হয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন রংপুর কলেজে। কিন্তু মশার উপদ্রবে সেই কলেজ ছাড়লেন। ভর্তি হলেন রাজশাহী কলেজে। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া তার ভালো লাগেনি। কোনমতে চার মাস থাকার পর তিনি কুচবিহারে কলেজে ফিরে আসেন। এখানেই তিনি বি.এ ক্লাসে ভর্তি হন।

এখানে একটা মজার তথ্য আছে। সে যুগে বিএ ক্লাসে মুসলিম ছাত্রদের সংস্কৃত ভাষা নিয়ে পড়তে হতো,অন্যদিকে হিন্দু ছাত্রদের পড়তে হতো ফারসী ভাষা। তা, আব্বাসউদ্দিন পড়াশুনায় এত ভালো ছিলেন যে, সংস্কৃত ভাষার পরীক্ষাতে তিনি অসাধারণ রেজাল্ট করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতার জন্য তিনি কাব্যরত্নাকর উপাধিও লাভ করেছিলেন। সে সময় নিজের নামের শেষে তিনি কাব্যরত্নাকর লিখতেন।

#
কলকাতায় একদিন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যাকে তিনি কাজীদা বলে ডাকতেন, সেই কাজীদা একদিন তাঁকে বললেন, নামের শেষে এত বড় লেজ লাগিয়েছো কেন সেদিন থেকেই তিনি ওই কাব্যরত্নাকর উপাধি নামের শেষে লেখা বন্ধ করলেন। শুধু লিখতেন আব্বাসউদ্দিন।

যাইহোক, বরাবর পড়াশুনায় অত্যন্ত ভালো ছাত্র, স্কুল জীবনে প্রতি ক্লাসে যিনি সবসময় প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছেন, তিনি কিন্তু কুচবিহার কলেজে বিএ পরীক্ষা পাস করতে পারলেন না। বাবা জাফর আলী আহমেদ, যিনি তুফানগঞ্জ আদালতে ওকালতী করতেন, তার কিন্তু ইচ্ছে ছিল ছেলে বি এ পাস করে ব্যারিস্টার হবে। কিন্তু বাবার সেই স্বপ্ন সফল হলো না। ছেলে গানের জগতকেই তার জীবনের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হিসাবে বেছে নিলেন।

গানের জগতের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে তিনি কলকাতায় আসলেন। কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংএ ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী কেরানী পদে চাকরি পেলেন। একদিকে চলল চাকরি আর একদিকে চলতে থাকলে তার গানের অনুশীলন, বিভিন্ন জায়গায় গানের অনুষ্ঠান আর গানের টিউশনি করা। দু’বছর পরেই বাংলা সরকারের কৃষি দপ্তরে স্থায়ী কেরানি পদে ভালো বেতনের একটি চাকরি পেলেন।

ইতিমধ্যেই গ্রামফোন রেকর্ডের দৌলতে লোকসংগীত শিল্পী হিসেবে আব্বাসউদ্দিনের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলা জুড়ে। প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক আব্বাসউদ্দিনের গান খুবই পছন্দ করতেন। তিনি আব্বাসউদ্দিনকে “রেকর্ডিং এক্সপার্ট টু দ্য গভরমেন্ট অফ বেঙ্গল” পদে নিয়োগ করলেন। বলাবাহুল্য, এই পদটি তার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছিল।
এই কলকাতা শহরেই তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রমূখ বড় বড় ক্রিয়েটিভ মানুষদের সাথে। এদের মধ্যে কবি নজরুল ইসলামের সাথেই তার ঘনিষ্ঠতা ছিল সবচেয়ে বেশি।

একদিন তিনি কবিকে বলেছিলেন, কাজিদা, এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল -- এরা উর্দু কাওয়ালী গান গায়, এদের গান, শুনেছি, অসম্ভব বিক্রি হয়। এই ধরনের বাংলায় ইসলামী গান দিলে হয় না? আপনি যদি ইসলামিক গান লেখেন তাহলে কিন্তু গানের জগতে একটা বিপ্লব হতে পারে।

সব শুনে নজরুল ইসলাম বললেন, আব্বাস, তুমি আগে ভগবতীবাবুর সাথে কথা বল।

এই ভগবতী বাবুর নাম হল ভগবতী ভট্টাচার্য। এইচ এম ভি গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির তিনি হলেন রিহার্সাল ইনচার্জ -- ৬০ বছরের ঝানু বৃদ্ধ। সব শুনে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, বললেন, না না, ইসলামিক গান একদম চলবে না। আব্বাস, তুমি তো জানোই মুসলিমরা গানবাজনা পছন্দ করেনা। ইসলামিক গানের রেকর্ড বার করে কোম্পানি এত বড় ঝুঁকি নিতে পারেনা। ব্যবসা একেবারে লাটে উঠে যাবে।

সেদিনের মতো আব্বাসউদ্দিন বেশ দমে গেলেন। কিন্তু মাস ছয়েক পরেই আবার তিনি ভগবতীবাবুকে বললেন, আচ্ছা একটা এক্সপেরিমেন্ট করেই দেখুন না, যদি বিক্রি না হয় আর ইসলামিক গান দেবেন না, ক্ষতি কি?

নাছোড়বান্দা আব্বাসউদ্দিনকে দেখে শেষপর্যন্ত ভগবতীবাবু রাজি হলেন। সেদিন পাশের ঘরেই উপস্থিত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আব্বাসউদ্দিন দৌড়ে গেলেন সে ঘরে। জানালেন, ভগবতীবাবু রেকর্ড করতে রাজি হয়েছেন। সেদিনই নজরুল ইসলাম ভরদুপুরে দরজা বন্ধ করে আধ ঘন্টার ভিতরে লিখে ফেললেন তার সেই বিখ্যাত গান: ১) ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
ঠিক পরের দিন লিখলেন আরও একটি বিখ্যাত গান: ২) ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর
গান দুটিতে সুরসংযোগ করে কবি নজরুল ইসলাম আব্বাসউদ্দিনকে গানদুটি শিখিয়ে দিলেন। যেদিন গান দুটি লেখা হয়েছিল, ঠিক তার চারদিন পরেই আব্বাসউদ্দিনের কন্ঠে গান দুটিকে রেকর্ড করা হলো। দুমাস পরেই ছিল ঈদ। ঈদের আগেই বাজারে ছাড়া হলো এইচ এম ভি গ্রামফোন কোম্পানির সেই ইসলামিক গানের রেকর্ড। বরাবাহুল্য, সেই গান দুটি জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গেল। আজও তা সমান ভাবেই জনপ্রিয়।

এরপরেই কাজী নজরুল ইসলাম এবং আব্বাসউদ্দিনের যৌথ উদ্যোগে একে একে অসাধারণ সব ইসলামিক গানের রেকর্ড বাজারে বের হলো। উল্লেখযোগ্য গানগুলি ছিল: ১) আল্লা নামের বীজ বনেছি ২) আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয় ৩) ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায় ৪) এল আবার ঈদ, ফিরে এলো আবার ঈদ, চলো ঈদগাহে

আল্লাহ-রসুলের গান পেয়ে বাংলার মুসলমানদের ঘরে ঘরে জেগে উঠলো এক নতুন উন্মাদনা।

আব্বাসউদ্দিন তার নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, যারা গান শুনলে কানে আঙুল দিত, তারাই কান থেকে হাত সরিয়ে তন্ময় হয়ে শুনতে থাকলো সেই গান। বাস্তবিকই, আব্বাসউদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক যিনি ইসলামিক গানের বাণিজ্যিকভাবে রেকর্ড তৈরি করে সফল হয়েছিলেন। শুনলে আশ্চর্য হবেন যে, তাঁর সাফল্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সেসময় অনেক হিন্দু গায়করাও মুসলমান ছদ্মনাম নিয়ে ইসলামিক গান রেকর্ড করা শুরু করেছিলেন।

#
আব্বাসউদ্দিন ছিলেন জিন্নাহপন্থী। দেশ ভাগের পক্ষে তিনি বরাবর সোচ্চার ছিলেন। পাকিস্তান গড়ে তোলার লোক্ষ্যে তাঁর গান মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ৪৭-এর দেশভাগের সময় তিনি পাকিস্তান অংশে অর্থাৎ পূর্ববঙ্গে চলে যান। ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দপ্তরে অ্যাডিশনাল সং-অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন।

১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংগীত সম্মেলনে, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যোগদান করেছিলেন।

তিনি বাংলা চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলির নাম হলো বিষ্ণুমায়া (১৯৩২) মহানিশা (১৯৩৬) একটি কথা (১৯৪০) ও ঠিকাদার (১৯৪০)

#
সংগীত জগতে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৬০ সালে মরণোত্তর প্রাইড অফ পারফর্মেন্স, ১৯৭৯ সালে শিল্পকলা অ্যাকাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৮১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।

আব্বাসউদ্দিন আহমেদ মাত্র ৫৮ বছর বেঁচে ছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৫৯ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, বুধবার সকাল সাতটা কুড়ি মিনিটে তিনি প্রয়াত হন।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলার এই অসামান্য লোকসংগীত শিল্পী, ভাওয়াইয়া সম্রাট, বাংলার বুলবুল বলে খ্যাত -- লোকসংগীত, পল্লীগীতির সুরকার, গায়ক শিল্পী, সংগীতপরিচালক আব্বাসউদ্দিনের নাম বাংলার সংগীত জগতের ইতিহাসে চিরকালের জন্য স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

(প্রতিবেদনটিকে ভিডিওতে দেখতে এই বাক্যটিতে ক্লিক করুন।) ....................................................................................

তথ্যঋণ:
১) আমার শিল্পী জীবনের কথা
By আব্বাস উদ্দিন আহমদ
২) আব্বাস উদ্দিন আহমদ
By ড. তপন বাগচী
৪) উইকিপিডিয়া

Comments

Popular posts from this blog

জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্যদেবী : বিয়ের গল্প / Jibanananda Das and Labanya Debi : Marriage Story

বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম : উত্থান-পতনের আশ্চর্য ইতিহাস / History : Vande Mataram by Bankim Chandra

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : প্রথম চুম্বন, মদ্যপান আর প্রেমের গল্প / Sunil Gangopadhyay : Story of First Kiss, Wine and Love