ছট পূজা : শুধুমাত্র কি বিহারের উৎসব? / Chhath Puja : Is it only a Bihar festival?
ছট পূজা বা ছট উৎসব সম্পর্কে আমরা সবাই মোটামুটি তিনটি বিষয় ভালোভাবেই জানি। প্রথমত, এই উৎসব সূর্যদেব এবং তাঁর স্ত্রী ঊষা, যিনি দেবী ষষ্ঠী নামে পরিচিত --- এই দুজনের নামেই উৎসর্গ করা হয়। দ্বিতীয়তঃ আমরা জানি যে, দীপাবলি উৎসবের পরেই কার্তিক
মাসের অমাবস্যা তিথিতে অর্থাৎ শুক্লা চতুর্থী থেকে সপ্তমী পর্যন্ত এই ব্রত পালিত হয়, যার মধ্যে ষষ্ঠী তিথি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য , তাৎপর্যপূর্ণ । সবশেষে আমরা এটাও জানি যে, বিহার রাজ্যের মানুষদের মধ্যেই এই ছট উৎসব পালন করার আধিক্য সর্বাধিক, যদিও বিহার সংশ্লিষ্ট ঝাড়খন্ড এবং উত্তরপ্রদেশে, এমন কি, নেপালেও এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়।
বিহারে এই উৎসবটা বিশাল একটা স্কেলে পালিত হয় বলে আমরা সবাই বলি যে, ছট পূজা হল শুধুমাত্র বিহারের উৎসব। আর এখানেই একটা প্রশ্ন ওঠে যে, ছট পূজা কি তাহলে একটি আঞ্চলিক উৎসব? শুধুমাত্র বিহারের উৎসব? নাকি নাকি এর শেকড় প্রসারিত রয়েছে বহুদূর পর্যন্ত? আজকের ভিডিওতে আমরা এসব প্রশ্নের একটা বিশ্লেষণমূলক মীমাংসা করার চেষ্টা করব। তবে তার আগে আমরা জেনে নেব বিহারের ছট উৎসব সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য।
দেখুন, বিহারে প্রায় প্রতিটি পরিবার ছট পূজায় অংশগ্রহণ করে। ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিহার এবং ঝাড়খণ্ড মিলিয়েমিশিয়ে, সেখানে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ এই ছট পূজায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এবং তার ফলে সে বছর প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল।
সত্যি কথা বলতে কি, বিহারের অর্থনীতি ও জনজীবনে ছট পূজার ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসায়ীরা, বিভিন্ন পেশার মানুষজন থেকে সরকার স্বয়ং – সবাই মিলে একটা বিশেষ ছককে অনুসরণ করে, একটা সুনির্দিষ্ট পথে এই ছট উৎসবের প্রস্তুতি তারা গ্রহণ করে। আসলে বিহারে এই উৎসব কেবলমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়; এটাকে বলা যায় বিহারের একটা .. একটা…সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রাণস্পন্দনের রূপচিত্র।
তা এই ছট উৎসবকে সেখানে বলা হয় মহাপর্ব। একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় যে এই মহাপর্বের, এই ছট উৎসবের তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে।
প্রথমত, ভৌগোলিক স্বতন্ত্রতা। সেটা কী? দেখুন, আমরা সবাই জানি, ছট পূজার ঘনত্ব এবং তীব্রতা পূর্ব ভারতের গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে সর্বাধিক। ভক্তরা পবিত্র স্নানের জন্যে এবং অর্ঘ্য নিবেদনের জন্য গঙ্গা নদী বা তার শাখানদী ও উপনদীগুলির তীরে একত্রিত হন । যদিও চার দিনব্যাপী সূর্য উপাসনা এই পূজার মূল লক্ষ্য, কিন্তু শুধুমাত্র জলকে অবলম্বন করেই এই পূজা ভৌগলিকভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় সন্নিবিষ্ট হয় --- এটাই হল ছট পূজোর ভৌগোলিক স্বতন্ত্রতা, অর্থাৎ পুজোর জন্য ভক্তরা নির্দিষ্ট স্থানেই জড়ো হন। দ্বিতীয়তঃ পূজার স্থিতিস্থাপকতা। স্থিতিস্থাপকতা বলতে বোঝাতে চাইছি এটাই যে, যেহেতু এই পূজায় কখনো মূর্তিপূজা করা হয় না, থাকে না কোন পুরোহিত, সেজন্য পূজা পদ্ধতি বেশ সহজবোধ্য ও সহজসাধ্য। বিধি-নিষেধের কোন গেড়ো না থাকার ফলে সর্বসাধারণের কাছে এই পুজো পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। সেজন্যই বলা হয়, এক ধরনের স্থিতিস্থাপকতা এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট অর্থাৎ পুজোর পদ্ধতিটি কখনই rigid নয়, তা আসলে নমনীয়, স্থিতিস্থাপক।
তৃতীয়তঃ সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। হ্যাঁ, এই পুজো বিহারের মানুষদের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। যেহেতু ৩৬ ঘন্টা নির্জলা উপবাস এই পুজোর অন্যতম অঙ্গ, সেজন্য বলা যায় যে, চারদিন ব্যাপী এই পূজোতে একটা একটা কাঠিন্য সম্পৃক্ত হয়ে আছে। বলাবাহুল্য , এই কাঠিন্যের কারণেই ছট পুজো অন্যান্য পূজো থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র। আর এই স্বতন্ত্রতার কারণেই এই ছট পূজা বিহারের মানুষদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক।
কিন্তু কিন্তু ছট পূজার সাথে এত কিছু অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও এই পূজাকে শুধুমাত্র একটা স্থানীয় উৎসব বা বিহারের উৎসব বলে পরিচয় দিলে সেটা হবে মস্ত বড় ভুল। কেন? চলুন এবার সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
দেখুন, ইতিহাসবিদরা বলেছেন, ছট পূজার ঐতিহাসিক শেকড় প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় ও পৌরাণিক ঐতিহ্যে নিহিত। তাঁদের বক্তব্য ‘ছট পূজা শুধুমাত্র বিহারের উৎসব’ এই যে ধারণা, এই ধারণাটিকে তাদের বক্তব্য আসলে জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করে।
ছট পূজার উৎস অনুসন্ধান করলে আপনার দেখতে পাবেন, এই পুজোর প্রাচীনত্ব বৈদিক যুগ পর্যন্ত প্রসারিত, কেনোনা, হিন্দুধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদেই সূর্যদেবতার বন্দনার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। ঋগ্বেদীয় যুগে সূর্য ছিলেন ইন্দ্র বা বায়ুর মতোই প্রধান দেবতাদের মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া, বৈদিক মন্ত্রগুলির মধ্যে গায়ত্রী মন্ত্রও কিন্তু সূর্যউপাসনা-কেন্দ্রিক।। অর্থাৎ এইসব তথ্যগুলি প্রমাণ করে যে, ছট পুজো শুধুমাএ বিহারের উৎসব নয়, আসলে এটি উৎসগতভাবে সুপ্রাচীন এবং সর্বভারতীয়। আবার ছট পূজা যে আঞ্চলিক সীমার ঊর্ধ্বে এক সর্বভারতীয় পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে স্থাপিত, তার প্রমাণ কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনিতে পাওয়া যায়। রামায়ণের কথা বললে বলতে হয় সেই গল্পটি, যেখানে মুদগল ঋষি, রাবণ বধের পাপ থেকে মুক্তির জন্যে রামচন্দ্র ও সীতাকে সূর্য উপাসনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তা, ঋষির সেই নির্দেশ মেনে সীতাদেবী কিন্তু কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে ছ’দিন ধরে সূর্যদেবের উপাসনা করেছিলেন।
অন্যদিকে মহাভারতের কথা যদি বলেন, সেখানেও উল্লেখ আছে, পাণ্ডবরা পাশা খেলায় রাজপাট হারিয়ে নির্বাসনে গেলে, দ্রৌপদী মহর্ষি ধৌম্যর পরামর্শে ছট ব্রত পালন করেছিলেন । আবার মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র কর্ণ, যিনি সূর্যপুত্র ছিলেন, তিনি প্রতিদিন কোমর জলে দাঁড়িয়ে সূর্যকে অর্ঘ্য নিবেদন করতেন।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, ছট পূজায় সূর্যদেবের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী ঊষাদেবী, তাকে কিন্তু ষষ্ঠীদেবী হিসাবে পূজা করা হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, ষষ্ঠী দেবী হলেন ব্রহ্মার মানস কন্যা, যাঁর অপর নাম দেবসেনা এবং যিনি প্রকৃতির ষষ্ঠ অংশ । তাঁকে সাধারণত শিশুদের রক্ষাকর্ত্রী এবং নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তান লাভের বরদাত্রী হিসেবে পূজা করা হয়।
যাইহোক, ইতিহাসগত উপাদান এবং পৌরাণিক উপাদান --- এই দুই দৃষ্টিকোণের যাবতীয় রেফারেন্স এই বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, ছট উৎসব কখনোই নিছক কোন স্থানীয় উৎসব বা লোকসংস্কৃতি নয়, শুধুমাত্র বিহারের উৎসব নয়, প্রকৃতপক্ষে এই উৎসব প্রাচীন ভারতীয়। প্রাচীন ভারতীয় সৌর উপাসনার নামান্তরই হল আজকের ছট পূজা।
প্রাচীন ভারত থেকে যদি আমরা আধুনিক ভারতে আসি, আমরা দেখতে পাব, বিহারের সঙ্গে সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায় বছর পর বছর ধরে ছট পূজা মহা ধুমধামে পালিত হচ্ছে। অর্থাৎ জনশ্রুতিতে এটা বিহারের উৎসব হলেও ইদানিং কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এটা ব্যাপভাবে একটা সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
কলকাতা ছাড়া দিল্লিতে এবং অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরগুলিতে আজকাল মহাসমারোহে এই ছট উৎসব পালিত হচ্ছে। তাছাড়া আপনি যদি বিদেশের দিকে তাকান, টাইমস অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে, লন্ডনে, দুবাইতে, যেখানেই বিহারী সম্প্রদায়ের মানুষজন আছে, সেখানে কিন্তু তারা ছট উৎসব পালন করছেন।
তা, সত্যি সত্যিই ছট পূজা এখন শুধু ভারত বা নেপালের অঞ্চলে নয়, বিশ্বজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মরিশাস, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েলস, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি বহু দেশে বসবাসরত ভারতীয় বিহারী সম্প্রদায়ের মানুষজন এই উৎসব পালন করছেন।

....................................................................................
তথ্যঋণ:
বিহারে এই উৎসবটা বিশাল একটা স্কেলে পালিত হয় বলে আমরা সবাই বলি যে, ছট পূজা হল শুধুমাত্র বিহারের উৎসব। আর এখানেই একটা প্রশ্ন ওঠে যে, ছট পূজা কি তাহলে একটি আঞ্চলিক উৎসব? শুধুমাত্র বিহারের উৎসব? নাকি নাকি এর শেকড় প্রসারিত রয়েছে বহুদূর পর্যন্ত? আজকের ভিডিওতে আমরা এসব প্রশ্নের একটা বিশ্লেষণমূলক মীমাংসা করার চেষ্টা করব। তবে তার আগে আমরা জেনে নেব বিহারের ছট উৎসব সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য।
দেখুন, বিহারে প্রায় প্রতিটি পরিবার ছট পূজায় অংশগ্রহণ করে। ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিহার এবং ঝাড়খণ্ড মিলিয়েমিশিয়ে, সেখানে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ এই ছট পূজায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এবং তার ফলে সে বছর প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল।
সত্যি কথা বলতে কি, বিহারের অর্থনীতি ও জনজীবনে ছট পূজার ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসায়ীরা, বিভিন্ন পেশার মানুষজন থেকে সরকার স্বয়ং – সবাই মিলে একটা বিশেষ ছককে অনুসরণ করে, একটা সুনির্দিষ্ট পথে এই ছট উৎসবের প্রস্তুতি তারা গ্রহণ করে। আসলে বিহারে এই উৎসব কেবলমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়; এটাকে বলা যায় বিহারের একটা .. একটা…সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রাণস্পন্দনের রূপচিত্র।
তা এই ছট উৎসবকে সেখানে বলা হয় মহাপর্ব। একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় যে এই মহাপর্বের, এই ছট উৎসবের তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে।
প্রথমত, ভৌগোলিক স্বতন্ত্রতা। সেটা কী? দেখুন, আমরা সবাই জানি, ছট পূজার ঘনত্ব এবং তীব্রতা পূর্ব ভারতের গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে সর্বাধিক। ভক্তরা পবিত্র স্নানের জন্যে এবং অর্ঘ্য নিবেদনের জন্য গঙ্গা নদী বা তার শাখানদী ও উপনদীগুলির তীরে একত্রিত হন । যদিও চার দিনব্যাপী সূর্য উপাসনা এই পূজার মূল লক্ষ্য, কিন্তু শুধুমাত্র জলকে অবলম্বন করেই এই পূজা ভৌগলিকভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় সন্নিবিষ্ট হয় --- এটাই হল ছট পূজোর ভৌগোলিক স্বতন্ত্রতা, অর্থাৎ পুজোর জন্য ভক্তরা নির্দিষ্ট স্থানেই জড়ো হন। দ্বিতীয়তঃ পূজার স্থিতিস্থাপকতা। স্থিতিস্থাপকতা বলতে বোঝাতে চাইছি এটাই যে, যেহেতু এই পূজায় কখনো মূর্তিপূজা করা হয় না, থাকে না কোন পুরোহিত, সেজন্য পূজা পদ্ধতি বেশ সহজবোধ্য ও সহজসাধ্য। বিধি-নিষেধের কোন গেড়ো না থাকার ফলে সর্বসাধারণের কাছে এই পুজো পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। সেজন্যই বলা হয়, এক ধরনের স্থিতিস্থাপকতা এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট অর্থাৎ পুজোর পদ্ধতিটি কখনই rigid নয়, তা আসলে নমনীয়, স্থিতিস্থাপক।
তৃতীয়তঃ সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। হ্যাঁ, এই পুজো বিহারের মানুষদের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। যেহেতু ৩৬ ঘন্টা নির্জলা উপবাস এই পুজোর অন্যতম অঙ্গ, সেজন্য বলা যায় যে, চারদিন ব্যাপী এই পূজোতে একটা একটা কাঠিন্য সম্পৃক্ত হয়ে আছে। বলাবাহুল্য , এই কাঠিন্যের কারণেই ছট পুজো অন্যান্য পূজো থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র। আর এই স্বতন্ত্রতার কারণেই এই ছট পূজা বিহারের মানুষদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক।
কিন্তু কিন্তু ছট পূজার সাথে এত কিছু অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও এই পূজাকে শুধুমাত্র একটা স্থানীয় উৎসব বা বিহারের উৎসব বলে পরিচয় দিলে সেটা হবে মস্ত বড় ভুল। কেন? চলুন এবার সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
দেখুন, ইতিহাসবিদরা বলেছেন, ছট পূজার ঐতিহাসিক শেকড় প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় ও পৌরাণিক ঐতিহ্যে নিহিত। তাঁদের বক্তব্য ‘ছট পূজা শুধুমাত্র বিহারের উৎসব’ এই যে ধারণা, এই ধারণাটিকে তাদের বক্তব্য আসলে জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করে।
ছট পূজার উৎস অনুসন্ধান করলে আপনার দেখতে পাবেন, এই পুজোর প্রাচীনত্ব বৈদিক যুগ পর্যন্ত প্রসারিত, কেনোনা, হিন্দুধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদেই সূর্যদেবতার বন্দনার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। ঋগ্বেদীয় যুগে সূর্য ছিলেন ইন্দ্র বা বায়ুর মতোই প্রধান দেবতাদের মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া, বৈদিক মন্ত্রগুলির মধ্যে গায়ত্রী মন্ত্রও কিন্তু সূর্যউপাসনা-কেন্দ্রিক।। অর্থাৎ এইসব তথ্যগুলি প্রমাণ করে যে, ছট পুজো শুধুমাএ বিহারের উৎসব নয়, আসলে এটি উৎসগতভাবে সুপ্রাচীন এবং সর্বভারতীয়। আবার ছট পূজা যে আঞ্চলিক সীমার ঊর্ধ্বে এক সর্বভারতীয় পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে স্থাপিত, তার প্রমাণ কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনিতে পাওয়া যায়। রামায়ণের কথা বললে বলতে হয় সেই গল্পটি, যেখানে মুদগল ঋষি, রাবণ বধের পাপ থেকে মুক্তির জন্যে রামচন্দ্র ও সীতাকে সূর্য উপাসনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তা, ঋষির সেই নির্দেশ মেনে সীতাদেবী কিন্তু কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে ছ’দিন ধরে সূর্যদেবের উপাসনা করেছিলেন।
অন্যদিকে মহাভারতের কথা যদি বলেন, সেখানেও উল্লেখ আছে, পাণ্ডবরা পাশা খেলায় রাজপাট হারিয়ে নির্বাসনে গেলে, দ্রৌপদী মহর্ষি ধৌম্যর পরামর্শে ছট ব্রত পালন করেছিলেন । আবার মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র কর্ণ, যিনি সূর্যপুত্র ছিলেন, তিনি প্রতিদিন কোমর জলে দাঁড়িয়ে সূর্যকে অর্ঘ্য নিবেদন করতেন।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, ছট পূজায় সূর্যদেবের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী ঊষাদেবী, তাকে কিন্তু ষষ্ঠীদেবী হিসাবে পূজা করা হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, ষষ্ঠী দেবী হলেন ব্রহ্মার মানস কন্যা, যাঁর অপর নাম দেবসেনা এবং যিনি প্রকৃতির ষষ্ঠ অংশ । তাঁকে সাধারণত শিশুদের রক্ষাকর্ত্রী এবং নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তান লাভের বরদাত্রী হিসেবে পূজা করা হয়।
যাইহোক, ইতিহাসগত উপাদান এবং পৌরাণিক উপাদান --- এই দুই দৃষ্টিকোণের যাবতীয় রেফারেন্স এই বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, ছট উৎসব কখনোই নিছক কোন স্থানীয় উৎসব বা লোকসংস্কৃতি নয়, শুধুমাত্র বিহারের উৎসব নয়, প্রকৃতপক্ষে এই উৎসব প্রাচীন ভারতীয়। প্রাচীন ভারতীয় সৌর উপাসনার নামান্তরই হল আজকের ছট পূজা।
প্রাচীন ভারত থেকে যদি আমরা আধুনিক ভারতে আসি, আমরা দেখতে পাব, বিহারের সঙ্গে সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায় বছর পর বছর ধরে ছট পূজা মহা ধুমধামে পালিত হচ্ছে। অর্থাৎ জনশ্রুতিতে এটা বিহারের উৎসব হলেও ইদানিং কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এটা ব্যাপভাবে একটা সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
কলকাতা ছাড়া দিল্লিতে এবং অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরগুলিতে আজকাল মহাসমারোহে এই ছট উৎসব পালিত হচ্ছে। তাছাড়া আপনি যদি বিদেশের দিকে তাকান, টাইমস অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে, লন্ডনে, দুবাইতে, যেখানেই বিহারী সম্প্রদায়ের মানুষজন আছে, সেখানে কিন্তু তারা ছট উৎসব পালন করছেন।
তা, সত্যি সত্যিই ছট পূজা এখন শুধু ভারত বা নেপালের অঞ্চলে নয়, বিশ্বজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মরিশাস, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েলস, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি বহু দেশে বসবাসরত ভারতীয় বিহারী সম্প্রদায়ের মানুষজন এই উৎসব পালন করছেন।

১) আনন্দবাজার পত্রিকা
২) এই সময়
৩) জেমিনি
৪) চ্যাটজিপিটি
৫) গুগল নেটওয়ার্ক
(এই প্রতিবেদনটিকে ভিডিওতে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।)



Comments
Post a Comment