ছকভাঙা জগদ্ধাত্রী পূজা : কৃষ্ণনগরের গল্প / Exceptional Jagadhatri Puja : Krishnanagar
জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালির ঐতিহ্য। প্রতি বছর কৃষ্ণনগর-চন্দননগরসহ শান্তিপুর, নবদ্বীপ এবং আরো অন্যান্য জায়গায় ধুমধাম করে জগদ্ধাত্রী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলার বুকে অনুষ্ঠিত হওয়া অজস্র জগদ্ধাত্রী পূজার মধ্যে বেশ কিছু পূজা আছে যা একেবারেই ব্যতিক্রমী, বলা যায় ছকভাঙ্গা পুজো ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এই পুজোগুলি আসলে অনন্যসাধারণ। বলাবাহুল্য, সেই পুজোগুলিকে খুঁজে বার করা এবং সেই পুজোগুলি কী কারনে ব্যতিক্রমী বা ছকভাঙ্গা ---- তা যুক্তিসহ ব্যাখ্যা করা বেশ কষ্টসাধ্য।
এই প্রতিবেদনে সেই কাজটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে করা হয়েছে। এই কাজের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে কৃষ্ণনগর শহরের জগদ্ধাত্রী পূজাগুলিকে। এই প্রতিবেদনে পাঠ করে, আমার ধারণা, পাঠক সহজেই ব্যতিক্রমী জগদ্ধাত্রী পুজোগুলির অবস্থান, ব্যতিক্রমী হওয়ার কারণ ও যুক্তিসহ ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি করে নিতে পারবেন। ভবিষ্যতে চন্দননগর সহ অন্যান্য জায়গার ব্যতিক্রমী পুজোগুলিকে নিয়ে গবেষণা ভিত্তিক একটি প্রতিবেদন তৈরি করার পরিকল্পনা আছে। যাইহোক, এবার ইতিহাসের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।
কৃষ্ণনগর । দুটি নদীর ভালোবাসায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে নদীয়ার এই সদর শহর --- কৃষ্ণনগর। শহরের বুক চিরে চলে গেছে একটা নদী। নাম অঞ্জনা। আরেকটি নদী শহরের উত্তর দিকে বয়ে চলেছে। পোশাকি নাম জলঙ্গি, কিন্তু তার একটি সুন্দর ডাকনাম আছে। খড়ে ----- খড়ে নদী।
এই খড়ে বা জলঙ্গী নদীর তীরে মালোপাড়া। এখানেই মালো সম্প্রদায়ের বসবাস। এরা মূলত মৎস্যজীবী। সামাজিকঅবস্থার নিরিখে এই মালোরা, এরা কিন্তু প্রান্তিক মানুষের দল। যেহেতু সারা বছর ধরে জলই তাদের জীবন-জীবিকা, সেজন্য কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর জগদ্ধাত্রী প্রতিমা জলঙ্গীতে বিসর্জনের সময়, এরা বরাবর মনপ্রাণ দিয়ে অনেক সাহায্য করত।
তা, এভাবে বেশ কয়েক বছর চলার পর একদিন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মালোপাড়ার মানুষদেরকে ডেকে বললেন, তোমরা এতদিন রাজরাজেশ্বরীর বিসর্জনে প্রভূত সাহায্য করেছে। আমার ইচ্ছে, তোমরা কিছু অর্থ সাহায্য গ্রহণ করো।
একথা শুনে মালোপাড়ার এক প্রবীণ মানুষ এগিয়ে এসে বললেন, মহারাজ আমরা গরীব মানুষ। মাছ ধরেই আমাদের জীবন কাটে। এত কষ্টের মধ্যেও মায়ের বিসর্জনে যে আমরা সামিল হতে পারি--- এটাই আমাদের বড় আনন্দ। যদি আপনি অনুমতি দেন তবে আমরা আমাদের পাড়ায় --- মালোপাড়ায়--- জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করতে পারি।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মালোদের এই প্রস্তাব লুফে নিয়েছিলেন। এর পিছনের কারণ হিসেবে অনেক মতামত আছে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে সমাজ বিজ্ঞানীরা, যে কারণটিকে মান্যতা দিয়েছেন, তা হল এই যে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র -- তিনি ছিলেন একজন শাক্ত উপাসক। তিনি মনেপ্রানে চাইতেন, প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে যেন বৈষ্ণবী ভাবধারার প্রসার না ঘটে। আর সেই কারণেই তিনি চাইছিলেন প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে বেশি করে জগদ্ধাত্রী পুজো ছড়িয়ে পড়ুক। সেদিন, মালো সম্প্রদায়ের সেই প্রবীণ মানুষটিকে তিনি বলেছিলেন, তোমরা জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করো। পুজোর খরচ বাবদ রাজ পরিবার থেকে তোমরা ১৫ টাকা করে সাহায্য পাবে।
শুনলে অবাক হবেন যে, সেই সময় থেকে রাজবাড়ীর ১৫ টাকা বা সমমূল্যের অর্থসাহায্য এখনো পায় মালোপাড়া। বলাবাহুল্য, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী থেকে আর কোনো জগদ্ধাত্রী পুজো এরকম ধারাবাহিকভাবে অর্থ সাহায্য পায় না। আর এই কারণেই মালোপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো এক ব্যতিক্রমী পুজো।
মালোপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো কিন্তু আরেকটি কারণে ব্যতিক্রমী। আর তা হলো জলভরা প্রথা। অষ্টমী তিথিতে জলঙ্গি থেকে কলসী ভরে পুজোর জন্য জল তুলে আনা হয়। আর এই জলভরার কাজটি মেয়েরা কিন্তু করেনা, শুনলে চমকে যাবেন, মেয়েদের শাড়ি পড়ে, মেয়েদের সাজপোশাকে এই কাজটি সম্পন্ন করে ছেলেরাই। তা, মেয়েদের সাজে ছেলেদের জল ভরে আনার এই অনুষ্ঠানের জন্যেও মালোপাড়ার জগদ্ধাত্রী ব্যতিক্রমী।
> #
2000 সালের পর থেকে কৃষ্ণনগরে বিভিন্ন পুজো মণ্ডপে বারোয়ারি প্রতিমার নতুন নতুন নামকরণের একটা হিড়িক পড়েছিল। উদাহরণ হিসাবে কয়েকটি বড় পুজোর কথা আপনাদের বলতেই পারি।
যেমন ধরুন, চকের পাড়ার বারোয়ারি প্রতিমার নামকরণ করা হয় আদিমা। মল্লিক পাড়ার বারোয়ারি প্রতিমার নামকরণ করা হয় দক্ষিণী মা। তেমনি গোবিন্দ সড়ক বারোয়ারী পুজোর প্রতিমার নামকরণ করা হয় আলোকেশ্বরী মা। অঞ্জনা পাড়ার বারোয়ারী প্রতিমার নামকরণ করা হয় ছোট বুড়ি মা। আবার চাষাপাড়ার দেবীপ্রতিমার নাম বুড়িমা। তেমনি অন্যদিকে, মালোপাড়া বারোয়ারী এবং গোলাপট্টি বারোয়ারি ---এই দুক্ষেত্রেই প্রতিমা, জলেশ্বরী মা নামে পরিচিত। তেমনি আনন্দময়ীতলা এবং গোয়াড়ী --- এখানেও দুক্ষেত্রেই প্রতিমার নাম বালোকেশ্বরী।
তা, চুনারীপাড়া বা নুড়িপাড়া বারোয়ারি দেবীপ্রতিমার একটি বিশেষ নামকরণ করা হয়েছে। প্রতিমার নাম দেওয়া হয়েছে চারদিনী মা। নামকরণ শুনেই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, এই পুজোটি সম্পুর্ণ ব্যতিক্রমী।
বিষয়টি হল এই যে, কৃষ্ণনগরের প্রত্যেকটি জগদ্ধাত্রী পুজো একদিনেই সম্পন্ন হয়, এবং সেই দিনটি হল নবমীর দিন, অর্থাৎ নবমীর দিনেই ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী -- সব তিথিগুলোর সেদিনই পুজো হয়, যদিও পঞ্চমী বা ষষ্ঠী থেকে দেবীদর্শন, সাজসজ্জা ইত্যাদি চলতেই থাকে। ব্যতিক্রম হল এই পূজোটি, চারদিনী মায়ের পুজো, যেখানে চারদিন ধরে অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রত্যেকদিন তিথি অনুযায়ী, চারদিন ধরে দেবী পূজা হয়। সেজন্যই এই দেবী প্রতিমার নামকরণ চারদিনী মা।
এখন প্রশ্ন হল, কেনো এই ব্যতিক্রম? দেখুন, এ বিষয়ে কংক্রিট কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে অনুমান করা যায় দুটি বিষয়। এক. সম্ভবত তৎকালীন পুজোর কর্মকর্তারা জগদ্ধাত্রী পুজোর গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে নিজেদের স্বতন্ত্র ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন। এবং সেকাজে অবশ্যই তারা সফল। আর দুই. সেই সময়ের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের যথোপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার লক্ষ্যেও চারদিনব্যাপী পুজোর ব্যবস্থা চালু করা হতে পরে বলে অনেকে মনে করেন। সুতরাং এ পুজো যে ব্যতিক্রমী পূজো, সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
#
আপনারা সবাই জানেন যে, জগদ্ধাত্রী দেবীপ্রতিমার বিসর্জন অনুষ্ঠানে কৃষ্ণনগর শহরের একটা ঐতিহ্য আছে। যদিও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাল্টে গেছে বিসর্জনের ধরন, তবু বহু ক্ষেত্রে রীতিনীতি কিন্তু একই আছে। যেমন ধরুন, দেবীমূর্তি বিসর্জনের আগে ঘট বিসর্জন হয়। আবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকে আজও সাং-এর ঠাকুরগুলোকে আগে বিসর্জন দেওয়া হয়, পরে অন্যান্য দেবী প্রতিমার নিরঞ্জন হয়। তবে একটা সময় ছিল , যখন রাজবাড়ীর জগদ্ধাত্রী দেবী, রাজরাজেশ্বরীকে জলঙ্গীর কদমতলা ঘাটে সবার আগে বিসর্জন দেওয়া হতো, এখন কিন্তু তা আর হয় না। এখন রাজবাড়ির ঠাকুর বিসর্জন হয় রাজবাড়ীর দিঘিতেই।
তবে বিসর্জনের একটি বিশেষ প্রথা কিন্তু আজও অক্ষুন্ন আছে। সেটা হল এই যে, বিসর্জনের আগে কৃষ্ণনগরের প্রত্যেক বারোয়ারির জগদ্ধাত্রী দেবীমূর্তিকে রাজবাড়ীতে নিয়ে আসা হয়। রাজবাড়ীতে রাণী মার দেবীদর্শন হলে, অথবা রানী মার অনুপস্থিতিতে রাজবাড়ীর মানুষদের দেবীদর্শন হলে, প্রতিমাগুলিকে ঘুরিয়ে জলঙ্গিতে নিয়ে বিসর্জন দেওয়া হতো।
তা, এখানেই একটি ব্যতিক্রমী পূজা আছে। এই বারোয়ারী পূজোর জগদ্ধাত্রী দেবীমূর্তি, তাকে কিন্তু কখনোই রাজবাড়িতে নিয়ে আসা হয় না।মন্ডপ থেকেই রাজবাড়ীর উল্টো দিক মুখ করে সোজা জলঙ্গীতে নিয়ে গিয়ে, তাকে বিসর্জন দেয়া হয়। এই ব্যতিক্রমী বারোয়ারী পূজোটি নেদেরপাড়া বারোয়ারি পুজো।
ইতিহাস বলে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই এই অঞ্চলের বাসিন্দারা, মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা, মহারাজাকে কোন রাজস্ব তারা দিত না।রাজস্ব বা কর না দেওয়া পাড়া ধীরে ধীরে লোকমুখে পরিচিত হয় না দেবার পাড়া বা অপভ্রংশে নেদেরপাড়া হিসাবে। যেহেতু এই পাড়াটি কখনোই কোন কর দিত না, সেজন্য রাজবাড়ীতে জগদ্ধাত্রী দেবীকে নিয়ে যাওয়ার কোন দায়ও তাঁদের ছিল না বিসর্জনের দিন কৃষ্ণনগরের সব জগদ্ধাত্রী দেবীপ্রতিমা যখন রাজবাড়ীমুখো, সেই সময় এই প্রতিমাটি কিন্তু উল্টো দিক মুখ করে জলঙ্গিঅভিমুখী। আর এই বৈচিত্রের জন্যই এই পূজোটি ব্যাতিক্রমী জগদ্ধাত্রী পূজা হিসাবে আজও চিহ্নিত হয়ে আছে।
#
আপনাদের আগেই বলেছি, আনন্দময়ীতলা এবং গোয়াড়ী --- এই দুই বারোয়ারি পুজোর দেবীপ্রতিমার নাম একই --- বালোকেশ্বরী মা। আপনারা জানেন যে, জগদ্ধাত্রী দেবীর পায়ের তলায় থাকে হাতির মাথা। তা, আনন্দময়ীতলার কাছে যেখানে বালকেশ্বরী মা রয়েছেন, সেখানে কিন্তু দেবী মায়ের পায়ের তলায় হাতির মাথা থাকে না, বরং থাকে একটা বল।
অনেক গবেষকদের মতে, জগদ্ধাত্রী দেবীমূর্তি এবং গন্ধেশ্বরী দেবীমূর্তি একেবারে একরকম, তফাৎ হলো গন্ধেশ্বরীদেবীর সিংহের পায়ের তলায় থাকে বল, আর জগদ্ধাত্রী দেবীর ক্ষেত্রে পায়ের তলায় থাকে হাতির মাথা।
অথচ আনন্দময়ীতলার বালোকেশ্বরী মায়ের পায়ের তলায় হাতির মাথার বদলে থাকে একটি বল। এজন্যই অনেকে মনে করেন যে, একমাত্র এই বারোয়ারি পূজা মন্ডপেই গন্ধেশ্বরী দেবীকেই জগদ্ধাত্রী দেবী হিসেবে পূজা করা হয়। আর এই কারণেই এই পুজোটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী জগদ্ধাত্রী পূজা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
#
দেখুন, গবেষকরা বলছেন যে, কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী দেবীর পূজায় যে ভোগ দেয়া হয়, সাধারণত সেই ভোগ হয় আমিষ। কিন্তু মাছ বা মাংস দিয়ে তৈরি করা কোন আমিষ সেখানে থাকে না। সাধারণত তিনভাবে সেই আমিষ তৈরি করা হয়। এক. সিদ্ধি এবং ছোলা একসঙ্গে বেটে মাছের আকারে বড়া তৈরি করে মাছের অনুকল্প হিসাবে আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। দুই. কখনো কখনো মুলো দিয়ে মাছের অনুকল্প তৈরি করে ভোগ দেওয়া হয়। আর তিন. শাস্ত্র অনুসারে মোষের দুধ, গরুর দুধ, ছাগলের দুধ এবং ফলমূল মিশিয়ে আমিষ ভোগ দেওয়া হয়।
তা, এখানে আমি দুটি ব্যতিক্রমী জগদ্ধাত্রী পূজোর কথা বলব যেখানে সরাসরি মাছ দিয়ে দেবীর ভোগ দেওয়া হয়।। এই দুটি পুজো হল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর পুজো এবং মালোপাড়া বারোয়ারি পুজো --- এই দুটি ক্ষেত্রে তিন রকমের মাছ --- ইলিশ কাতলা আর রুই ---- এই তিন রকমের মাছ দিয়ে দেবীর ভোগ দেওয়া হয়। সুতরাং ভোগ দেওয়ার উপর ভিত্তি করে এই দুটি পুজো কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী।
মনে রাখা দরকার, ব্যতিক্রম সাধারণ স্রোতকে নির্দেশ করে না, কিন্তু কখনো কখনো ব্যাতিক্রমীই স্বাভাবিক স্রোতে পর্যবসিত হয়। গতানুগতিকতা থেকে এভাবেই হয়তো মুক্তির পথ উদ্ভাসিত হয়। ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ছকভাঙ্গা জগদ্ধাত্রী পুজো হয়তো একদিন নতুন দিশার নির্দেশ দিতে পারে, এটুকুই বলার। ....................................................................................
(প্রতিবেদনটি ভিডিওতে দেখতে এই বাক্যে ক্লিক করুন) তথ্যঋণ
১) জগদ্ধাত্রী উৎস সন্ধানে
By সুপ্রতিম কর্মকার
২) জগদ্ধাত্রী পূজা : সেকাল থেকে একাল
By শুভম মণ্ডল
৩) জেমিনি
৪) চ্যাটজিপিটি
৫) উইকিপিডিয়া
৬) গুগল নেটওয়ার্ক
লেখা : ৩০/১০/২৫
এই প্রতিবেদনে সেই কাজটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে করা হয়েছে। এই কাজের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে কৃষ্ণনগর শহরের জগদ্ধাত্রী পূজাগুলিকে। এই প্রতিবেদনে পাঠ করে, আমার ধারণা, পাঠক সহজেই ব্যতিক্রমী জগদ্ধাত্রী পুজোগুলির অবস্থান, ব্যতিক্রমী হওয়ার কারণ ও যুক্তিসহ ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি করে নিতে পারবেন। ভবিষ্যতে চন্দননগর সহ অন্যান্য জায়গার ব্যতিক্রমী পুজোগুলিকে নিয়ে গবেষণা ভিত্তিক একটি প্রতিবেদন তৈরি করার পরিকল্পনা আছে। যাইহোক, এবার ইতিহাসের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।
কৃষ্ণনগর । দুটি নদীর ভালোবাসায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে নদীয়ার এই সদর শহর --- কৃষ্ণনগর। শহরের বুক চিরে চলে গেছে একটা নদী। নাম অঞ্জনা। আরেকটি নদী শহরের উত্তর দিকে বয়ে চলেছে। পোশাকি নাম জলঙ্গি, কিন্তু তার একটি সুন্দর ডাকনাম আছে। খড়ে ----- খড়ে নদী।
এই খড়ে বা জলঙ্গী নদীর তীরে মালোপাড়া। এখানেই মালো সম্প্রদায়ের বসবাস। এরা মূলত মৎস্যজীবী। সামাজিকঅবস্থার নিরিখে এই মালোরা, এরা কিন্তু প্রান্তিক মানুষের দল। যেহেতু সারা বছর ধরে জলই তাদের জীবন-জীবিকা, সেজন্য কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর জগদ্ধাত্রী প্রতিমা জলঙ্গীতে বিসর্জনের সময়, এরা বরাবর মনপ্রাণ দিয়ে অনেক সাহায্য করত।
তা, এভাবে বেশ কয়েক বছর চলার পর একদিন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মালোপাড়ার মানুষদেরকে ডেকে বললেন, তোমরা এতদিন রাজরাজেশ্বরীর বিসর্জনে প্রভূত সাহায্য করেছে। আমার ইচ্ছে, তোমরা কিছু অর্থ সাহায্য গ্রহণ করো।
একথা শুনে মালোপাড়ার এক প্রবীণ মানুষ এগিয়ে এসে বললেন, মহারাজ আমরা গরীব মানুষ। মাছ ধরেই আমাদের জীবন কাটে। এত কষ্টের মধ্যেও মায়ের বিসর্জনে যে আমরা সামিল হতে পারি--- এটাই আমাদের বড় আনন্দ। যদি আপনি অনুমতি দেন তবে আমরা আমাদের পাড়ায় --- মালোপাড়ায়--- জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করতে পারি।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মালোদের এই প্রস্তাব লুফে নিয়েছিলেন। এর পিছনের কারণ হিসেবে অনেক মতামত আছে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে সমাজ বিজ্ঞানীরা, যে কারণটিকে মান্যতা দিয়েছেন, তা হল এই যে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র -- তিনি ছিলেন একজন শাক্ত উপাসক। তিনি মনেপ্রানে চাইতেন, প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে যেন বৈষ্ণবী ভাবধারার প্রসার না ঘটে। আর সেই কারণেই তিনি চাইছিলেন প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে বেশি করে জগদ্ধাত্রী পুজো ছড়িয়ে পড়ুক। সেদিন, মালো সম্প্রদায়ের সেই প্রবীণ মানুষটিকে তিনি বলেছিলেন, তোমরা জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করো। পুজোর খরচ বাবদ রাজ পরিবার থেকে তোমরা ১৫ টাকা করে সাহায্য পাবে।
শুনলে অবাক হবেন যে, সেই সময় থেকে রাজবাড়ীর ১৫ টাকা বা সমমূল্যের অর্থসাহায্য এখনো পায় মালোপাড়া। বলাবাহুল্য, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী থেকে আর কোনো জগদ্ধাত্রী পুজো এরকম ধারাবাহিকভাবে অর্থ সাহায্য পায় না। আর এই কারণেই মালোপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো এক ব্যতিক্রমী পুজো।
মালোপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো কিন্তু আরেকটি কারণে ব্যতিক্রমী। আর তা হলো জলভরা প্রথা। অষ্টমী তিথিতে জলঙ্গি থেকে কলসী ভরে পুজোর জন্য জল তুলে আনা হয়। আর এই জলভরার কাজটি মেয়েরা কিন্তু করেনা, শুনলে চমকে যাবেন, মেয়েদের শাড়ি পড়ে, মেয়েদের সাজপোশাকে এই কাজটি সম্পন্ন করে ছেলেরাই। তা, মেয়েদের সাজে ছেলেদের জল ভরে আনার এই অনুষ্ঠানের জন্যেও মালোপাড়ার জগদ্ধাত্রী ব্যতিক্রমী।
> #
2000 সালের পর থেকে কৃষ্ণনগরে বিভিন্ন পুজো মণ্ডপে বারোয়ারি প্রতিমার নতুন নতুন নামকরণের একটা হিড়িক পড়েছিল। উদাহরণ হিসাবে কয়েকটি বড় পুজোর কথা আপনাদের বলতেই পারি।
যেমন ধরুন, চকের পাড়ার বারোয়ারি প্রতিমার নামকরণ করা হয় আদিমা। মল্লিক পাড়ার বারোয়ারি প্রতিমার নামকরণ করা হয় দক্ষিণী মা। তেমনি গোবিন্দ সড়ক বারোয়ারী পুজোর প্রতিমার নামকরণ করা হয় আলোকেশ্বরী মা। অঞ্জনা পাড়ার বারোয়ারী প্রতিমার নামকরণ করা হয় ছোট বুড়ি মা। আবার চাষাপাড়ার দেবীপ্রতিমার নাম বুড়িমা। তেমনি অন্যদিকে, মালোপাড়া বারোয়ারী এবং গোলাপট্টি বারোয়ারি ---এই দুক্ষেত্রেই প্রতিমা, জলেশ্বরী মা নামে পরিচিত। তেমনি আনন্দময়ীতলা এবং গোয়াড়ী --- এখানেও দুক্ষেত্রেই প্রতিমার নাম বালোকেশ্বরী।
তা, চুনারীপাড়া বা নুড়িপাড়া বারোয়ারি দেবীপ্রতিমার একটি বিশেষ নামকরণ করা হয়েছে। প্রতিমার নাম দেওয়া হয়েছে চারদিনী মা। নামকরণ শুনেই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, এই পুজোটি সম্পুর্ণ ব্যতিক্রমী।
বিষয়টি হল এই যে, কৃষ্ণনগরের প্রত্যেকটি জগদ্ধাত্রী পুজো একদিনেই সম্পন্ন হয়, এবং সেই দিনটি হল নবমীর দিন, অর্থাৎ নবমীর দিনেই ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী -- সব তিথিগুলোর সেদিনই পুজো হয়, যদিও পঞ্চমী বা ষষ্ঠী থেকে দেবীদর্শন, সাজসজ্জা ইত্যাদি চলতেই থাকে। ব্যতিক্রম হল এই পূজোটি, চারদিনী মায়ের পুজো, যেখানে চারদিন ধরে অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রত্যেকদিন তিথি অনুযায়ী, চারদিন ধরে দেবী পূজা হয়। সেজন্যই এই দেবী প্রতিমার নামকরণ চারদিনী মা।
এখন প্রশ্ন হল, কেনো এই ব্যতিক্রম? দেখুন, এ বিষয়ে কংক্রিট কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে অনুমান করা যায় দুটি বিষয়। এক. সম্ভবত তৎকালীন পুজোর কর্মকর্তারা জগদ্ধাত্রী পুজোর গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে নিজেদের স্বতন্ত্র ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন। এবং সেকাজে অবশ্যই তারা সফল। আর দুই. সেই সময়ের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের যথোপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার লক্ষ্যেও চারদিনব্যাপী পুজোর ব্যবস্থা চালু করা হতে পরে বলে অনেকে মনে করেন। সুতরাং এ পুজো যে ব্যতিক্রমী পূজো, সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
#
আপনারা সবাই জানেন যে, জগদ্ধাত্রী দেবীপ্রতিমার বিসর্জন অনুষ্ঠানে কৃষ্ণনগর শহরের একটা ঐতিহ্য আছে। যদিও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাল্টে গেছে বিসর্জনের ধরন, তবু বহু ক্ষেত্রে রীতিনীতি কিন্তু একই আছে। যেমন ধরুন, দেবীমূর্তি বিসর্জনের আগে ঘট বিসর্জন হয়। আবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকে আজও সাং-এর ঠাকুরগুলোকে আগে বিসর্জন দেওয়া হয়, পরে অন্যান্য দেবী প্রতিমার নিরঞ্জন হয়। তবে একটা সময় ছিল , যখন রাজবাড়ীর জগদ্ধাত্রী দেবী, রাজরাজেশ্বরীকে জলঙ্গীর কদমতলা ঘাটে সবার আগে বিসর্জন দেওয়া হতো, এখন কিন্তু তা আর হয় না। এখন রাজবাড়ির ঠাকুর বিসর্জন হয় রাজবাড়ীর দিঘিতেই।
তবে বিসর্জনের একটি বিশেষ প্রথা কিন্তু আজও অক্ষুন্ন আছে। সেটা হল এই যে, বিসর্জনের আগে কৃষ্ণনগরের প্রত্যেক বারোয়ারির জগদ্ধাত্রী দেবীমূর্তিকে রাজবাড়ীতে নিয়ে আসা হয়। রাজবাড়ীতে রাণী মার দেবীদর্শন হলে, অথবা রানী মার অনুপস্থিতিতে রাজবাড়ীর মানুষদের দেবীদর্শন হলে, প্রতিমাগুলিকে ঘুরিয়ে জলঙ্গিতে নিয়ে বিসর্জন দেওয়া হতো।
তা, এখানেই একটি ব্যতিক্রমী পূজা আছে। এই বারোয়ারী পূজোর জগদ্ধাত্রী দেবীমূর্তি, তাকে কিন্তু কখনোই রাজবাড়িতে নিয়ে আসা হয় না।মন্ডপ থেকেই রাজবাড়ীর উল্টো দিক মুখ করে সোজা জলঙ্গীতে নিয়ে গিয়ে, তাকে বিসর্জন দেয়া হয়। এই ব্যতিক্রমী বারোয়ারী পূজোটি নেদেরপাড়া বারোয়ারি পুজো।
ইতিহাস বলে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই এই অঞ্চলের বাসিন্দারা, মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা, মহারাজাকে কোন রাজস্ব তারা দিত না।রাজস্ব বা কর না দেওয়া পাড়া ধীরে ধীরে লোকমুখে পরিচিত হয় না দেবার পাড়া বা অপভ্রংশে নেদেরপাড়া হিসাবে। যেহেতু এই পাড়াটি কখনোই কোন কর দিত না, সেজন্য রাজবাড়ীতে জগদ্ধাত্রী দেবীকে নিয়ে যাওয়ার কোন দায়ও তাঁদের ছিল না বিসর্জনের দিন কৃষ্ণনগরের সব জগদ্ধাত্রী দেবীপ্রতিমা যখন রাজবাড়ীমুখো, সেই সময় এই প্রতিমাটি কিন্তু উল্টো দিক মুখ করে জলঙ্গিঅভিমুখী। আর এই বৈচিত্রের জন্যই এই পূজোটি ব্যাতিক্রমী জগদ্ধাত্রী পূজা হিসাবে আজও চিহ্নিত হয়ে আছে।
#
আপনাদের আগেই বলেছি, আনন্দময়ীতলা এবং গোয়াড়ী --- এই দুই বারোয়ারি পুজোর দেবীপ্রতিমার নাম একই --- বালোকেশ্বরী মা। আপনারা জানেন যে, জগদ্ধাত্রী দেবীর পায়ের তলায় থাকে হাতির মাথা। তা, আনন্দময়ীতলার কাছে যেখানে বালকেশ্বরী মা রয়েছেন, সেখানে কিন্তু দেবী মায়ের পায়ের তলায় হাতির মাথা থাকে না, বরং থাকে একটা বল।
অনেক গবেষকদের মতে, জগদ্ধাত্রী দেবীমূর্তি এবং গন্ধেশ্বরী দেবীমূর্তি একেবারে একরকম, তফাৎ হলো গন্ধেশ্বরীদেবীর সিংহের পায়ের তলায় থাকে বল, আর জগদ্ধাত্রী দেবীর ক্ষেত্রে পায়ের তলায় থাকে হাতির মাথা।
অথচ আনন্দময়ীতলার বালোকেশ্বরী মায়ের পায়ের তলায় হাতির মাথার বদলে থাকে একটি বল। এজন্যই অনেকে মনে করেন যে, একমাত্র এই বারোয়ারি পূজা মন্ডপেই গন্ধেশ্বরী দেবীকেই জগদ্ধাত্রী দেবী হিসেবে পূজা করা হয়। আর এই কারণেই এই পুজোটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী জগদ্ধাত্রী পূজা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
#
দেখুন, গবেষকরা বলছেন যে, কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী দেবীর পূজায় যে ভোগ দেয়া হয়, সাধারণত সেই ভোগ হয় আমিষ। কিন্তু মাছ বা মাংস দিয়ে তৈরি করা কোন আমিষ সেখানে থাকে না। সাধারণত তিনভাবে সেই আমিষ তৈরি করা হয়। এক. সিদ্ধি এবং ছোলা একসঙ্গে বেটে মাছের আকারে বড়া তৈরি করে মাছের অনুকল্প হিসাবে আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। দুই. কখনো কখনো মুলো দিয়ে মাছের অনুকল্প তৈরি করে ভোগ দেওয়া হয়। আর তিন. শাস্ত্র অনুসারে মোষের দুধ, গরুর দুধ, ছাগলের দুধ এবং ফলমূল মিশিয়ে আমিষ ভোগ দেওয়া হয়।
তা, এখানে আমি দুটি ব্যতিক্রমী জগদ্ধাত্রী পূজোর কথা বলব যেখানে সরাসরি মাছ দিয়ে দেবীর ভোগ দেওয়া হয়।। এই দুটি পুজো হল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর পুজো এবং মালোপাড়া বারোয়ারি পুজো --- এই দুটি ক্ষেত্রে তিন রকমের মাছ --- ইলিশ কাতলা আর রুই ---- এই তিন রকমের মাছ দিয়ে দেবীর ভোগ দেওয়া হয়। সুতরাং ভোগ দেওয়ার উপর ভিত্তি করে এই দুটি পুজো কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী।
মনে রাখা দরকার, ব্যতিক্রম সাধারণ স্রোতকে নির্দেশ করে না, কিন্তু কখনো কখনো ব্যাতিক্রমীই স্বাভাবিক স্রোতে পর্যবসিত হয়। গতানুগতিকতা থেকে এভাবেই হয়তো মুক্তির পথ উদ্ভাসিত হয়। ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ছকভাঙ্গা জগদ্ধাত্রী পুজো হয়তো একদিন নতুন দিশার নির্দেশ দিতে পারে, এটুকুই বলার। ....................................................................................
(প্রতিবেদনটি ভিডিওতে দেখতে এই বাক্যে ক্লিক করুন) তথ্যঋণ
১) জগদ্ধাত্রী উৎস সন্ধানে
By সুপ্রতিম কর্মকার
২) জগদ্ধাত্রী পূজা : সেকাল থেকে একাল
By শুভম মণ্ডল
৩) জেমিনি
৪) চ্যাটজিপিটি
৫) উইকিপিডিয়া
৬) গুগল নেটওয়ার্ক
লেখা : ৩০/১০/২৫






Comments
Post a Comment