ফাটাকেষ্ট কালীপুজো : অবিশ্বাস্য জীবন কাহিনী / Fatakesto Kali Puja ; Incredible life Story
ফাটাকেষ্ট ওরফে কৃষ্ণচন্দ্র দত্তের জীবন মারকাটারি বলিউড সিনেমার চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। তাঁর উত্থানের পিছনে যেমন ছিল কালীভক্তি, তেমনই ছিল রক্তক্ষয়ী লড়াই এবং তাঁর অবিশ্বাস্য সাহস, যার দরুন স্থানীয় এক মস্তান থেকে 'ফাটাকেষ্ট' নামে কলকাতার শহরের বুকে একটা অবিশ্বাস্য মিথ তৈরি হয়েছিল।
কলেজ স্ট্রিটে তাঁর বাবার দোকান ছিল। পানের দোকান। সেখানেই সাধারণভাবে তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল। সে সময় তার একমাত্র নেশা ছিল শরীরচর্চা। ছোটখাটো চেহারা সত্বেও তিনি সুঠামো দেহের অধিকারী ছিলেন। নিয়মিত মনোহর আইচের আখড়ায় যেতেন, ডাম্বেল ভাঁজতেন, বাজার থেকে পাঁঠার গুড়দা কিনে নিয়ে আসতেন, সেদ্ধ করে তা তিনি খেতেন, দুধের মধ্যে কাঁচা ডিম গুলে তা তিনি চুমুক দিতেন। এভাবেই বানিয়ে ফেলেছিলেন তার শক্তপোক্ত চেহারা।
আর এই শারীরিক সক্ষমতাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
ষাটের দশকের শেষ দিকে, নকশাল আমলের শুরুতেই, সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের লাগোয়া নরসিংহ লেনে, তার ওপর আচমকা চড়াও হয়েছিল পাড়ারই এক মস্তান, নাম নকুল। নকুলের সঙ্গে ছিল বরাহনগরের দুর্ধর্ষ মস্তান নীলু। প্রাণ বাঁচাতে সদ্যযুবক কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত জড়িয়ে পড়েছিলেন ভয়াবহ চাকু-ছুরির লড়াইতে।
বাঘের মতন লড়াই করলেও শেষ পর্যন্ত ছুরির আঘাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত হলেন। ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিকেল হসপিটালে। বেঁচে ফেরার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু যমে মানুষের টানাটানির পর মনের জোরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন।
শরীরে গভীর ক্ষতচিহ্ন নিয়ে পাড়ায় ফিরলেন কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। আর তখন থেকেই তার নাম হল ফাটাকেষ্ট। অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে চেলা-সাগরেদদের নিয়ে শুরু হল তার নতুন জীবন। কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত থেকে গুন্ডা ফাটাকেষ্ট।
কালীভক্তি ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি। যখন তিনি কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত ছিলেন, তখন নিয়মিত ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির সামনে,আরতির সময় তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। দেবীমূর্তির দিকে তাকিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তিনিও এইরকম ভাবেই, এইররকম জাঁকজমক করেই কালীপুজো করবেন। বলাবাহুল্য, তাঁর সেই কালীভক্তিই পরবর্তীকালে তাঁর ক্ষমতা, তাঁর সামাজিক আকাঙ্ক্ষাকে, তাঁর প্রভাবশালী জীবন --- সবকিছুকে চালিত করেছিল।
১৯৫৫ সালে তিনি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে গুরুপ্রসাদ চৌধুরি লেনে প্রথম কালীপুজো শুরু করেন। পরে নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্যের জেরে পুজোটি সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের নবযুবক সংঘের কালীপুজো হিসেবে স্থানান্তরিত হয়, যা বছর দুই পরে পুলিশ এবং পুরসভার অনুমতি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। বলাবাহুল্য, এই বারোয়ারি কালীপুজোই ফাটাকেষ্টর কালীপুজো। আপনারা জানেন, শক্তি আরাধনার এই ধারা ছিল কলকাতা তথা সারা বাংলা জুড়ে বহু প্রাচীন। ইতিহাসবিদরা বলেন, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই বাংলার বুকে বারোয়ারী কালীপুজোর রীতি ছিল চোখে পড়ার মতো । সে যুগে, এই শক্তির আরাধনাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের মনে প্রভূত সাহস জুগিয়েছিল ।
পরবর্তীকালে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে, এই ধর্মীয় উৎসবটি বহু ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে স্থানীয় মস্তান আর রাজনৈতিক 'কেষ্টুবিষ্টু'দের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রদর্শনের একটি প্রধান মাধ্যম। ফাটাকেষ্টর কালীপুজো তার ব্যতিক্রম ছিল না। ছিল সেই ধারারই এক অন্যতম দৃষ্টান্ত, যেখানে ধর্মীয় উৎসব আর ক্ষমতা হাত ধরাধরি করে চলেছিল বেশ কয়েকটি দশক জুড়ে।
কলকাতার বুকে যখন নকশাল আন্দোলন ছিল তুঙ্গে, সেই সত্তরের দশকে, মির্জাপুর স্ট্রিটের এক মস্তান, নাম ছিল গন্ডার, ফাটাকেষ্টের দিকে বোমা ছুড়ে মেরেছিল। কিন্তু বোমাটা ফাটে নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিল, ফাটাকেষ্ট নাকি সেই বোমাটাই তুলে ছুড়ে মেরে দিয়েছিল গন্ডারের দিকে, গন্ডার অবশ্য বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু পাল্টা বোমা ছোড়ার সেই ভয়ংকর সাহসের ঘটনা ফাটাকেষ্টর রাজনৈতিক ক্ষমতার মিথ তৈরি করতে সর্বোচ্চ অনুঘটকের কাজ করেছিল। আশেপাশের সাধারণ লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, কালিভক্ত ফাটাকেষ্টের উপর মা কালীর আশীর্বাদ রয়েছে, মা কালীর বর রয়েছে।
শত্রুর বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের লড়াইতে জেতার জন্য ফাটাকেষ্ট যেমন ছিলেন সিদ্ধহস্ত, তেমনি আশ্চর্য এক জনসম্মোহিনী বিদ্যাও ছিল তাঁর করায়ত্ত। তিনি ভালো করেই জানতেন, মানুষকে কি করে চমকে দিতে হয়।
বছর বছর ধরে পুজোর মন্ডপে যেসব সেলিব্রেটিদের তিনি হাজির করাতেন,তাদের সম্পর্কে আগে থেকে জনসাধারণকে কোন খবর ঘুনাক্ষরেও তিনি দিতেন না। পূজোমন্ডপের পিছনের হ্যারিসন রোড ধরে ভিআইপিদের তিনি মঞ্চ নিয়ে আসতেন। আচমকা মাইকে ঘোষণা হতো বোম্বের মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন পূজা মন্ডপে হাজির হয়েছেন, মাইকের সেই ঘোষণায় শিহরিত জনসাধারণ তখন উন্মাদ। আর এই নাটকিয়তাই ছিল ফাটাকেষ্টর অন্যতম কারিশমা। এভাবেই তিনি মঞ্চে হাজির করেছেন অমিতাভ বচ্চন থেকে বিনোদ খান্না, রাজেশ খান্না, জিতেন্দ্র, মালা সিনহা, আর ডি বর্মন, আশা ভোঁসলে, বিশ্বখ্যাত রাশিয়ান গোলকিপার লেভ ইয়াসিন, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন প্রমুখ গ্ল্যামার জগতের সেলিব্রিটিদের। শুধু গ্ল্যামার জগতেরই নয়, আধ্যাত্মিক জগতের মানুষদেরও তিনি নিয়ে এসেছিলেন সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার গণ্ডির মধ্যে। কাশি থেকে আসা জটিজুটধারী বিখ্যাত যোগীগুরু সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, তাঁকে তিনি কাঁধে করে, যদুনাথ বোস লেন থেকে উত্তাল জনসমুদ্রের ভিড় ঠেলে নিয়ে এসেছিলেন পুজো মন্ডপে। সে দৃশ্যও ছিল অবিশ্বাস্য। তা, সময়ের তালে তালে ফাটাকেষ্টর কালীপুজোতে তারকাদের আনাগোনা হয়তো কমেছে অনেকটাই, কিন্তু ব্র্যান্ড ফাটাকেষ্টর জন্যই জৌলুস কিন্তু আছে একইরকম। আজও কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, কলকাতার বাইরে থেকে অজস্র মানুষ ছুটে আসেন দেবীর কাছে মানত করতে। হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে অঞ্জলি দেন। আজও সেই সময়কার অনেক রীতিনীতি নিয়ম করে পালন করা হয়।
যেমন ধরুন, কালীপুজোর ঠিক দশ দিন আগে ইকুমোরটুলিতেই দেবীর চক্ষুদান পর্ব সম্পন্ন হয়। আবার কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর মন্ডপে নিয়ে আসার আগে ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে পুজো দিয়ে আধ্যাত্মিক অনুমতি নেওয়া হয়। আজও শোনা যায়, কুমোরটুলি থেকে ফাটাকেষ্টর কালীঠাকুর না বেরোলে অন্য কোন ঠাকুর মণ্ডপে যায় না।। আজও কেবলমাত্র পূজারীই শুদ্ধ বস্ত্রে মায়ের ভোগ রাধেন।
দেবীমূর্তি সেই প্রথম থেকেই আজও গাঢ় নীল বর্ণের। সুবিশাল দেবীপ্রতিমা, ১৪ ফুটের দীর্ঘাঙ্গী তাঁর চেহারা। ওজন প্রায় ১টন। এবার অবশ্য প্রতিমাশিল্পীর পরিবর্তন ঘটেছে। ফাটাকেষ্টর সময়ে প্রতিমা গড়তেন স্বর্গীয় কালিপদ পাল। পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিমা গড়েছেন শিল্পী মাধব পাল। এ বছর নতুন শিল্পী মিন্টু পাল। ফাটাকেষ্টর কালীপুজোতে ভাসান দেওয়া ছিল যেমন একটা ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাপার, আজও কিন্তু সেই ধারা অব্যাহত আছে। ভাসানের সময় দেবীমূর্তি যে রাস্তায় নামানো হয়, সেই রাস্তা আগে থেকেই গঙ্গাজল দিয়ে ধোয়া হয়। তারপর অজস্র ফুল বিছিয়ে দেওয়া হয়। যেন দেখলে মনে হয় রাস্তা নয়, ফুলের কার্পেট। তাঁর উপর দিয়ে দেবী মূর্তিকে নিয়ে যাওয়া হয় ভাসানোর জন্য।
১৯৯২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৮বছর বয়সে আচমকা থেমে গিয়েছিল ফাটাকেষ্টের জীবন। কলকাতা শহরের বুকে ৭০ থেকে আশির দশকের মধ্যভাগ জুড়ে একদিকে তাঁর উপর মা কালীর দৈবআনুকূল্য, সঙ্গে সাধারণ লোকজনের অসীম বিশ্বাস, অন্যদিকে সেই সময়ের শাসক, কংগ্রেস দলের ছত্রছায়ায় তাঁর নকশাল দমন, পাশাপাশি মধ্যবিত্ত ছাপোষা মানুষদের আঞ্চলিক রক্ষাকর্তা, উপরন্তু সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে, এমনকি গ্ল্যামার জগতের স্টারডমের সঙ্গে তাঁর অনায়াস যোগাযোগ -- এই সবকিছুর এক এক অদ্ভুত মিশেলে কলকাতা শহর জুড়ে সেই সত্তর থেকে আশির দশকে রাজ করেছিলেন, রাজত্ব চালিয়েছিলেন এক অতিমানব, যার নাম ফাটাকেষ্ট, গুন্ডা ফাটাকেষ্ট। আজও, তাঁর সম্পর্কে রোমাঞ্চকর গল্পগাথা যা যা শোনা যায়, তার কতটা গুজব, কতটা কল্পনা, কতটা মিথ, কতটাই বা বাস্তব --- তা পরিমাপের জন্য বিশ্বাসযোগ্য কোনো উপায় নেই, আসলে সে বিচার করা প্রায় অসম্ভব।
তবে একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, অতিমানব সেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত ফাটাকেষ্টর জন্যই আজও তাঁর কালীপুজো নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রচুর আবেগ গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। আজ আর ফাটাকেষ্ট নেই, কিন্তু তাঁর কিংবদন্তি ইমেজ কালীপুজোকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র, কালীপুজোতেই ভাস্বর হয়ে আছে একটাই ব্র্যান্ড --- ব্র্যান্ড ফাটাকেষ্ট।
---------------------------------------###------------------------------------ (প্রতিবেদনটি ভিডিওতে দেখতে এই বাক্যটির উপর ক্লিক করুন)
কলেজ স্ট্রিটে তাঁর বাবার দোকান ছিল। পানের দোকান। সেখানেই সাধারণভাবে তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল। সে সময় তার একমাত্র নেশা ছিল শরীরচর্চা। ছোটখাটো চেহারা সত্বেও তিনি সুঠামো দেহের অধিকারী ছিলেন। নিয়মিত মনোহর আইচের আখড়ায় যেতেন, ডাম্বেল ভাঁজতেন, বাজার থেকে পাঁঠার গুড়দা কিনে নিয়ে আসতেন, সেদ্ধ করে তা তিনি খেতেন, দুধের মধ্যে কাঁচা ডিম গুলে তা তিনি চুমুক দিতেন। এভাবেই বানিয়ে ফেলেছিলেন তার শক্তপোক্ত চেহারা।
আর এই শারীরিক সক্ষমতাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
ষাটের দশকের শেষ দিকে, নকশাল আমলের শুরুতেই, সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের লাগোয়া নরসিংহ লেনে, তার ওপর আচমকা চড়াও হয়েছিল পাড়ারই এক মস্তান, নাম নকুল। নকুলের সঙ্গে ছিল বরাহনগরের দুর্ধর্ষ মস্তান নীলু। প্রাণ বাঁচাতে সদ্যযুবক কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত জড়িয়ে পড়েছিলেন ভয়াবহ চাকু-ছুরির লড়াইতে।
বাঘের মতন লড়াই করলেও শেষ পর্যন্ত ছুরির আঘাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত হলেন। ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিকেল হসপিটালে। বেঁচে ফেরার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু যমে মানুষের টানাটানির পর মনের জোরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন।
শরীরে গভীর ক্ষতচিহ্ন নিয়ে পাড়ায় ফিরলেন কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। আর তখন থেকেই তার নাম হল ফাটাকেষ্ট। অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে চেলা-সাগরেদদের নিয়ে শুরু হল তার নতুন জীবন। কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত থেকে গুন্ডা ফাটাকেষ্ট।
কালীভক্তি ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি। যখন তিনি কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত ছিলেন, তখন নিয়মিত ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির সামনে,আরতির সময় তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। দেবীমূর্তির দিকে তাকিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তিনিও এইরকম ভাবেই, এইররকম জাঁকজমক করেই কালীপুজো করবেন। বলাবাহুল্য, তাঁর সেই কালীভক্তিই পরবর্তীকালে তাঁর ক্ষমতা, তাঁর সামাজিক আকাঙ্ক্ষাকে, তাঁর প্রভাবশালী জীবন --- সবকিছুকে চালিত করেছিল।
১৯৫৫ সালে তিনি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে গুরুপ্রসাদ চৌধুরি লেনে প্রথম কালীপুজো শুরু করেন। পরে নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্যের জেরে পুজোটি সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের নবযুবক সংঘের কালীপুজো হিসেবে স্থানান্তরিত হয়, যা বছর দুই পরে পুলিশ এবং পুরসভার অনুমতি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। বলাবাহুল্য, এই বারোয়ারি কালীপুজোই ফাটাকেষ্টর কালীপুজো। আপনারা জানেন, শক্তি আরাধনার এই ধারা ছিল কলকাতা তথা সারা বাংলা জুড়ে বহু প্রাচীন। ইতিহাসবিদরা বলেন, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই বাংলার বুকে বারোয়ারী কালীপুজোর রীতি ছিল চোখে পড়ার মতো । সে যুগে, এই শক্তির আরাধনাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের মনে প্রভূত সাহস জুগিয়েছিল ।
পরবর্তীকালে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে, এই ধর্মীয় উৎসবটি বহু ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে স্থানীয় মস্তান আর রাজনৈতিক 'কেষ্টুবিষ্টু'দের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রদর্শনের একটি প্রধান মাধ্যম। ফাটাকেষ্টর কালীপুজো তার ব্যতিক্রম ছিল না। ছিল সেই ধারারই এক অন্যতম দৃষ্টান্ত, যেখানে ধর্মীয় উৎসব আর ক্ষমতা হাত ধরাধরি করে চলেছিল বেশ কয়েকটি দশক জুড়ে।
কলকাতার বুকে যখন নকশাল আন্দোলন ছিল তুঙ্গে, সেই সত্তরের দশকে, মির্জাপুর স্ট্রিটের এক মস্তান, নাম ছিল গন্ডার, ফাটাকেষ্টের দিকে বোমা ছুড়ে মেরেছিল। কিন্তু বোমাটা ফাটে নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিল, ফাটাকেষ্ট নাকি সেই বোমাটাই তুলে ছুড়ে মেরে দিয়েছিল গন্ডারের দিকে, গন্ডার অবশ্য বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু পাল্টা বোমা ছোড়ার সেই ভয়ংকর সাহসের ঘটনা ফাটাকেষ্টর রাজনৈতিক ক্ষমতার মিথ তৈরি করতে সর্বোচ্চ অনুঘটকের কাজ করেছিল। আশেপাশের সাধারণ লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, কালিভক্ত ফাটাকেষ্টের উপর মা কালীর আশীর্বাদ রয়েছে, মা কালীর বর রয়েছে।
শত্রুর বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের লড়াইতে জেতার জন্য ফাটাকেষ্ট যেমন ছিলেন সিদ্ধহস্ত, তেমনি আশ্চর্য এক জনসম্মোহিনী বিদ্যাও ছিল তাঁর করায়ত্ত। তিনি ভালো করেই জানতেন, মানুষকে কি করে চমকে দিতে হয়।
বছর বছর ধরে পুজোর মন্ডপে যেসব সেলিব্রেটিদের তিনি হাজির করাতেন,তাদের সম্পর্কে আগে থেকে জনসাধারণকে কোন খবর ঘুনাক্ষরেও তিনি দিতেন না। পূজোমন্ডপের পিছনের হ্যারিসন রোড ধরে ভিআইপিদের তিনি মঞ্চ নিয়ে আসতেন। আচমকা মাইকে ঘোষণা হতো বোম্বের মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন পূজা মন্ডপে হাজির হয়েছেন, মাইকের সেই ঘোষণায় শিহরিত জনসাধারণ তখন উন্মাদ। আর এই নাটকিয়তাই ছিল ফাটাকেষ্টর অন্যতম কারিশমা। এভাবেই তিনি মঞ্চে হাজির করেছেন অমিতাভ বচ্চন থেকে বিনোদ খান্না, রাজেশ খান্না, জিতেন্দ্র, মালা সিনহা, আর ডি বর্মন, আশা ভোঁসলে, বিশ্বখ্যাত রাশিয়ান গোলকিপার লেভ ইয়াসিন, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন প্রমুখ গ্ল্যামার জগতের সেলিব্রিটিদের। শুধু গ্ল্যামার জগতেরই নয়, আধ্যাত্মিক জগতের মানুষদেরও তিনি নিয়ে এসেছিলেন সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার গণ্ডির মধ্যে। কাশি থেকে আসা জটিজুটধারী বিখ্যাত যোগীগুরু সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, তাঁকে তিনি কাঁধে করে, যদুনাথ বোস লেন থেকে উত্তাল জনসমুদ্রের ভিড় ঠেলে নিয়ে এসেছিলেন পুজো মন্ডপে। সে দৃশ্যও ছিল অবিশ্বাস্য। তা, সময়ের তালে তালে ফাটাকেষ্টর কালীপুজোতে তারকাদের আনাগোনা হয়তো কমেছে অনেকটাই, কিন্তু ব্র্যান্ড ফাটাকেষ্টর জন্যই জৌলুস কিন্তু আছে একইরকম। আজও কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, কলকাতার বাইরে থেকে অজস্র মানুষ ছুটে আসেন দেবীর কাছে মানত করতে। হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে অঞ্জলি দেন। আজও সেই সময়কার অনেক রীতিনীতি নিয়ম করে পালন করা হয়।
যেমন ধরুন, কালীপুজোর ঠিক দশ দিন আগে ইকুমোরটুলিতেই দেবীর চক্ষুদান পর্ব সম্পন্ন হয়। আবার কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর মন্ডপে নিয়ে আসার আগে ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে পুজো দিয়ে আধ্যাত্মিক অনুমতি নেওয়া হয়। আজও শোনা যায়, কুমোরটুলি থেকে ফাটাকেষ্টর কালীঠাকুর না বেরোলে অন্য কোন ঠাকুর মণ্ডপে যায় না।। আজও কেবলমাত্র পূজারীই শুদ্ধ বস্ত্রে মায়ের ভোগ রাধেন।
দেবীমূর্তি সেই প্রথম থেকেই আজও গাঢ় নীল বর্ণের। সুবিশাল দেবীপ্রতিমা, ১৪ ফুটের দীর্ঘাঙ্গী তাঁর চেহারা। ওজন প্রায় ১টন। এবার অবশ্য প্রতিমাশিল্পীর পরিবর্তন ঘটেছে। ফাটাকেষ্টর সময়ে প্রতিমা গড়তেন স্বর্গীয় কালিপদ পাল। পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিমা গড়েছেন শিল্পী মাধব পাল। এ বছর নতুন শিল্পী মিন্টু পাল। ফাটাকেষ্টর কালীপুজোতে ভাসান দেওয়া ছিল যেমন একটা ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাপার, আজও কিন্তু সেই ধারা অব্যাহত আছে। ভাসানের সময় দেবীমূর্তি যে রাস্তায় নামানো হয়, সেই রাস্তা আগে থেকেই গঙ্গাজল দিয়ে ধোয়া হয়। তারপর অজস্র ফুল বিছিয়ে দেওয়া হয়। যেন দেখলে মনে হয় রাস্তা নয়, ফুলের কার্পেট। তাঁর উপর দিয়ে দেবী মূর্তিকে নিয়ে যাওয়া হয় ভাসানোর জন্য।
১৯৯২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৮বছর বয়সে আচমকা থেমে গিয়েছিল ফাটাকেষ্টের জীবন। কলকাতা শহরের বুকে ৭০ থেকে আশির দশকের মধ্যভাগ জুড়ে একদিকে তাঁর উপর মা কালীর দৈবআনুকূল্য, সঙ্গে সাধারণ লোকজনের অসীম বিশ্বাস, অন্যদিকে সেই সময়ের শাসক, কংগ্রেস দলের ছত্রছায়ায় তাঁর নকশাল দমন, পাশাপাশি মধ্যবিত্ত ছাপোষা মানুষদের আঞ্চলিক রক্ষাকর্তা, উপরন্তু সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে, এমনকি গ্ল্যামার জগতের স্টারডমের সঙ্গে তাঁর অনায়াস যোগাযোগ -- এই সবকিছুর এক এক অদ্ভুত মিশেলে কলকাতা শহর জুড়ে সেই সত্তর থেকে আশির দশকে রাজ করেছিলেন, রাজত্ব চালিয়েছিলেন এক অতিমানব, যার নাম ফাটাকেষ্ট, গুন্ডা ফাটাকেষ্ট। আজও, তাঁর সম্পর্কে রোমাঞ্চকর গল্পগাথা যা যা শোনা যায়, তার কতটা গুজব, কতটা কল্পনা, কতটা মিথ, কতটাই বা বাস্তব --- তা পরিমাপের জন্য বিশ্বাসযোগ্য কোনো উপায় নেই, আসলে সে বিচার করা প্রায় অসম্ভব।
তবে একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, অতিমানব সেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত ফাটাকেষ্টর জন্যই আজও তাঁর কালীপুজো নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রচুর আবেগ গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। আজ আর ফাটাকেষ্ট নেই, কিন্তু তাঁর কিংবদন্তি ইমেজ কালীপুজোকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র, কালীপুজোতেই ভাস্বর হয়ে আছে একটাই ব্র্যান্ড --- ব্র্যান্ড ফাটাকেষ্ট।
---------------------------------------###------------------------------------ (প্রতিবেদনটি ভিডিওতে দেখতে এই বাক্যটির উপর ক্লিক করুন)






Comments
Post a Comment