মান্না দে : কেমন করে গায়ক হলেন / Manna Dey : How a Singer born : A true Motivational Story

মান্না দে ছোট থেকেই বেশ ডাকাবুকো ছিলেন। সে সময় তাঁর নেশা ছিল তিনটি : এক.মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ি ওড়ানো, দুই,যতীন্দ্রচরণ গুহ তথা গোবরবাবুর আখড়ায় গিয়ে নিয়মিত কুস্তি করা, আর তিন,সময়-সুযোগ পেলেই এন্তার ফুটবল খেলা।

না,সেই কিশোরবেলায় সঙ্গীত নিয়ে বিন্দুমাত্র কোন মাতামাতি একদমই ছিল না। গান শেখাতো দূরের কথা,যেখানে গানের চর্চা হত,তার ত্রিসীমানায় পারতপক্ষে তিনি কখনোই পা রাখতেন না। জীবনে একটাই স্বপ্ন ছিল, গোবর বাবুর মত একজন পালোয়ান হবেন।

বাড়িতে ছিল সঙ্গীতের চর্চা। আপনারা হয়তো জানেন,মান্না দের ছোটকাকা,কৃষ্ণচন্দ্র দে,তিনি ছিলেন সে সময়ে ভারতবর্ষের একজন অন্যতম নামী গায়ক, গানের জগতে অসাধারণ এক বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব। তাঁর সাথে সময় কাটাতে প্রায়ই বাড়িতে চলে আসতেন শচীনদেব বর্মন, ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ,ওস্তাদ ফৈয়জ খাঁ ---- এরকম সব তাবড় তাবড় শিল্পীরা।

তা, ছোটকাকার সেই গানের ঘরে মান্না দে-সহ বাড়ির ছোটদের প্রবেশ কিন্তু ছিল একদম নিষিদ্ধ। তবে মান্না দে-কে মাঝে মাঝে সেই গানের ঘরে ডেকে নিতেন ছোটকাকা নিজেই। ঘরে বসে মান্না দে ছোটকাকার নির্দেশে গানের কথা,গানের সুর-তাল,বন্দিশ খাতায় টুকে রাখতেন। এর কারণ ছিল একটাই, ছোটকাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধ একজন গায়ক। সুতরাং, সাহায্যের জন্য কাউকে-না-কাউকে তার গানের ঘরে দরকার হতই।

একদিন ছোটকাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে একমনে গানের রেওয়াজ করছিলেন। গান করতে করতেই তিনি হঠাৎ মান্না দে-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, মানা, তুমি আজ একটু তানপুরাটাতে সুর ছাড়ো তো। কথাটা শুনে মান্না দে তো একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। কাকা বলেন কি! মান্না দে তো তানপুরা বাজাতেই পারেন না,তানপুরায় সুর ছাড়বেন কি করে! কিন্তু কাকা বলেছেন মানে তা করতেই হবে, কাকার ইচ্ছে মানে কাকার আদেশ।

বাধ্য হয়ে মান্না দে তানপুরা নিয়ে সুর ছাড়তে শুরু করলেন। কিন্তু সুর কি আর হয় নাকি? সুর তো বেরলোই না, উল্টো অদ্ভুত সব আওয়াজ বেরোলো। কাকা কিন্তু কিছুই বললেন না, সেই অদ্ভুত আওয়াজের মধ্যেই তিনি নিবিষ্ট মনে গান গেয়ে গেলেন।
পরের দিন আবারও মান্না দের ডাক পড়ল। মান্না দে আবারও আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করলেন। কাজের কাজ কিছুই হল না, কাকা কিন্তু আগের দিনের মতোই নিবিষ্ট চিত্তে গান গেয়ে গেলেন।

এরপর থেকে প্রায় রোজই মান্না দে কে ডেকে নিতেন ছোটকাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে। আর অবিশ্বাস্য ঘটনা হল এটাই যে,কাকার সামনে একটু একটু করে বাজাতে বাজাতে মান্না দে একদিন তানপুরা বাজানো শিখে গেলেন। শেখার মানটা এমন হলো যে,মাঝে মাঝে ছোটকাকার বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে তানপুরায় সুর ছাড়তেন স্বয়ং মান্না দে।
তবে তখনও পর্যন্ত তিনি গানের সারেগামা কিছুই শেখেন নি।

আরেকদিন বাড়ির সেই গানের ঘরে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। সেদিন ছোটকাকা আচমকা তার গানের অভ্যাস থামিয়ে মান্না দে-কে বললেন, মানা, আজ তানপুরাটা ভেলুকে দাও। ভেলু, মানে মান্না দের ছোটভাই প্রভাস চন্দ্র দে, পাশেই বসেছিলেন। মান্নাদে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তানপুরাটা ছোটভাইয়ের হাতে দিলেন। ছোটকাকা এবার বললেন,মানা, তুমি এবার হারমোনিয়ামটা আজ একটু বাজিয়ে দাও তো।

মান্না দে তো একদম কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কি করবেন তিনি? তিনি তো হারমোনিয়াম মোটেই বাজাতে পারেন না। এবার কি হবে? উপায়টা কি? না, কোন উপায় ছিল না। কাকা যখন বলেছেন, পারো আর না পারো,হারমোনিয়াম বাজাতেই হবে। অগত্যা মান্না দে সেই প্রথম হারমোনিয়াম বাজাতে শুরু করলেন এবং যথারীতি,প্রানপাত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, না হল কোন সুর, না হল কোন তাল। সেদিন যতই বেসুরো পর্দায় হারমোনিয়াম বাজুক না কেন, ছোটকাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে কখনো তার গান থামালেন না। তিনি একমনে গান গেয়ে গেলেন।

এ যেন একেবারে তানপুরা পর্বের পুনর্নির্মাণ। তানপুরা পর্বে যা হয়েছিল এখানেও তাই হল। রোজ রোজ কাকার গানের সাথে হারমোনিয়াম বাজানোর একটা আপ্রাণ চেষ্টা মান্না দে-কে করতে হয়েছিল। আর সেই মরিয়া চেষ্টাতেই একদিন মান্না দে হারমোনিয়াম বাজাতে শিখে গেলেন এবং রাতারাতি অবিশ্বাস্য ভাবে হারমোনিয়াম বাদ্যযন্ত্রটির পুরোদস্তুর একজন ওস্তাদ হয়ে উঠলেন।

তবে তখনো পর্যন্ত তিনি কিন্তু গানের সারেগামা কিছুই শিখে উঠতে পারেননি ---- শেখেননি।

তানপুরা এবং হারমোনিয়াম পর্বের শেষের দিকে মান্নাদের স্কুল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। তিনি ভর্তি হলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। তা, এই কলেজ জীবনই ছিল তার জীবনের একমাত্র টার্নিং পয়েন্ট। কি হয়েছিল সে সময়? একদম অবিশ্বাস্য ঘটনা।

কলেজে মান্না দে ক্লাসের একেবারে শেষ বেঞ্চে বসতেন। সেখানেই আরও কয়েকজন ব্যাকবেঞ্চারকে নিয়ে তৈরি হল তার বন্ধুবাহিনী। দুটো ক্লাসের ফাঁকে, বিশেষ করে টিফিনের সময় এই বন্ধুবাহিনী নিয়ে চলতো দেদার আড্ডা। আড্ডার শিরোমণি ছিলেন মান্না দে। মান্না দের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল -- একবার কোন গান শুনলেই সেই গানটি তিনি হুবহু গেয়ে দিতে পারতেন। গান তিনি শেখেননি, অথচ কলেজে টেবিলে তাল ঠুকে একের পর এক গানের ঝড় তুলতেন মান্না দে। আশেপাশে সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনত সেই সব গান। আড্ডা ঘিরে ভিড় জমে উঠত।

একদিন কি হল, কলেজে ঘোষণা করা হল, মাস দুয়েকের মধ্যেই কলেজে আয়োজিত হতে চলেছে ইন্টার কলেজ মিউজিক কম্পিটিশন। কলেজে ছাত্র-ছাত্রীরা আলোচনা শুরু করে দিল,কম্পিটিশনে কার কার নাম দেওয়াহবে, কে কলেজের সম্মান রক্ষা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি।মান্না দের বন্ধুবাহিনী,তারা কিন্তু মান্না দের মতামতের কোনো রকম তোয়াক্কা না করেই প্রতিযোগিতায় মান্না দের নাম দিয়ে দিল। সবার ধারনা একটাই,মান্না দে এত ভালো গান জানেন, মান্না দে-ই পারবেন কলেজের সম্মান রাখতে।

আর মান্না দে কিন্তু এবার চোখে অন্ধকার দেখলেন, তার তো গানের কোন তালিম নেই। তিনি তো আসলে গানের ব্যকরণ কিছুই জানেন না।

তিনি এই প্রতিযোগিতায় কি করে পেরে উঠবেন?
সেদিন সারারাত তিনি দু’চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ-ওপাশ করেই কেটে গেল একটা গোটা রাত। অবশেষে, মাথায় এক অদ্ভুত আইডিয়া খেলে গেল।

কলেজে গিয়ে সোজা বন্ধুদের বললেন, নারে, আমার গান গাওয়া হবে না রে। কাকার একদম মত নেই। তিনি একেবারেই চান না আমি কম্পিটিশনে নাম দিই। তোরা তো জানিস, আমার ছোটকাকা ভালো গাইলে কি হবে উনি আসলে ভীষণ রাগী মানুষ। একবার না বলে দিলে, আর তা নড়চড় হওয়ার কোনো রাস্তা নেই।

মান্না দের এই কথা শুনে বন্ধুরা তো হতাশ। তবে তারা কিন্তু হাল ছাড়ল না। মান্না দে-কে কোন কিছু না জানিয়ে, মান্না দে-কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তারা গোপনে মান্না দের বাড়িতে গিয়ে সটান ছোটকাকার দরবারে হাজির। প্রার্থনা একটাই, তিনি যেন মান্না দে-কে মিউজিক কম্পিটিশনে নামার জন্য পারমিশনটা দিয়ে দেন ।

ছোটকাকা তো সব শুনে রীতিমত অবাক। বলছে কি ওরা! তবে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন,মানা অর্থাৎ মান্না দে গানের কিছুই জানেনা,কোনদিন গানই শেখে নি। সুতরাং এভাবে বললেই কাউকে গান-বাজনার কম্পিটিশনে নামিয়ে দেওয়া যায় না। অর্থাৎ নো পারমিশন।

মান্না দের বন্ধুরা তখন হতাশায় ভেঙে পড়ল। তবু তাদের দম কিছুটা বাকি ছিল। তারা এবার সোজা চলল কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে। তখন স্কটিশ চার্চ কলজের প্রিন্সিপাল ছিলেন আরকুহার্ট সাহেব। ছাত্রছাত্রীরা তার কাছে গিয়ে অনুরোধ করলো,তিনি যেন মান্নাদের ছোটকাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-কে একটা চিঠি করে দেন, যাতে মান্না দে মিউজিক কম্পিটিশন নামতে পারে। তা, কলেজের প্রিন্সিপাল আরকুহার্ট সাহেবসব শুনেটুনে কৃষ্ণচন্দ্র দে-কে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে একটা চিঠি লিখে দিলেন।

প্রিন্সিপালের সেই চিঠিটি পড়ে কৃষ্ণচন্দ্র দে অবশেষে একরকম রাজি হলেন। প্রিন্সিপালের লেখা সেই চিঠির বয়ানটা ছিল এইরকম:
So the college authority will be grateful to you if you kindly allow Prabodh to participate in the forthcoming inter College music competition. Hope your goodself will consider the case.”

ছোটকাকা,সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে মান্না দে-কে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কম্পিটিশনের আর কতদিন বাকি আছে? মান্না দে জানালেন,দুমাস। ছোটকাকা এবার বললেন, গান না শিখে এভাবে কম্পিটিশনে নামাটা মোটেই ঠিক হচ্ছেনা। তুমি আজ থেকে দুবেলা আমার কাছে রেওয়াজ করবে।

সেই শুরু হলো মান্নাদের জীবনে আক্ষরিক অর্থে সংগীতশিক্ষা। ছোটকাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-ই হলেন তার প্রথম সংগীতগুরু। টানা দু’মাস চলল কঠোর কঠিন পরিশ্রম। সকাল-সন্ধ্যায় কাকা গান শেখাতেন আর মান্না দে শিখতেন। সুরের বা স্বরের কোন কাজেই জোড়াতালি মেরে নয়, বারবার চূড়ান্ত অনুশীলন করে একেবারে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে যেতেন তারা।
সেই পরিশ্রম কিন্তু বিফলে গেল না।

ইন্টার কলেজ মিউজিক কম্পিটিশনে,মান্না দে খেয়াল ভজন কীর্তন গজল --- প্রায় সব বিভাগে তিনি প্রথম হলেন। শুধুমাত্র ঠুংরি আর আধুনিক গানে তিনি দ্বিতীয় হলেন। মিউজিক কম্পিটিশনের রেজাল্ট নিয়ে মা-বাবা, বাড়ির সবাই ভীষণ খুশি।

কিন্তু ছোটকাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে, তিনি তেমন খুশি হলেন না। তার প্রশ্ন একটাই, ঠুংরি আর আধুনিক গানে মান্না দে কেন সেকেন্ড হলেন? বলাবাহুল্য, এই একই প্রশ্ন কিন্তু মান্না দেখেও তাড়া করে ফিরছিল। এর জবাব তার কাছেও ছিল না। শুধু এটুকু বুঝেছিলেন যে, তার অনুশীলনে নিশ্চিত কোথাও ঘাটতি আছে। সুতরাং শুরু হল আবার আরও আরও কঠিন, আরো কঠোর সাধনা।

শুনলে অবাক হবেন যে, সেই কঠোর কঠিন পরিশ্রমের ফলে পর পর তিন বছর ইন্টার কলেজ মিউজিক কম্পিটিশনে মান্না দে সব সব ক’টা বিভাগে একেবারে প্রথম হলেন, এবং গানে সব দিক দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তিনি পেলেন একটি রুপোর তানপুরা।

সেই তানপুরাটি কিন্তু গর্বের স্মৃতি হিসেবে কলেজে আজও সযত্নে রক্ষিত আছে। তারপর? তারপরে তো ইতিহাস।

মান্না দে চেয়েছিলেন, যতীন্দ্রচরণ গুহ তথা গোবরবাবুর মত বাংলার একজন অসাধারণ কুস্তিগীর হবেন, কিন্তু হয়ে গেলেন বাংলা তথা ভারতবর্ষের এক অনন্যসাধারণ কালজয়ী গায়ক, যাঁর নাম মানুষের হৃদয়ে সোনার অক্ষরে লেখা আছে চিরদিন।
.................................................................................... তথ্যঋণ:
১) জীবনের জলসাগরে by মান্না দে
২) উইকিপিডিয়া
৩) গুগল নেটওয়ার্ক
(এই প্রতিবেদনটি ভিডিওতে দেখতে এই বাক্যে ক্লিক করুন)

Comments

Popular posts from this blog

জীবনানন্দ দাশ ও লাবণ্যদেবী : বিয়ের গল্প / Jibanananda Das and Labanya Debi : Marriage Story

বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম : উত্থান-পতনের আশ্চর্য ইতিহাস / History : Vande Mataram by Bankim Chandra

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : প্রথম চুম্বন, মদ্যপান আর প্রেমের গল্প / Sunil Gangopadhyay : Story of First Kiss, Wine and Love