স্বপনকুমার : এক জিনিয়াসের ধূসর গল্প / Swapan Kumar : Story of a forgotten Star
“রাত তখন ঠিক কাঁটায়কাঁটায় আটটা বাজে। হ্যান্ডস আপ। মাথার উপর হাত তোলো শয়তান। পালাবার চেষ্টা করলে গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেবো।“ --- কি .... বলুন এই লাইনগুলোর কথা কি মনে পড়ছে আপনাদের? মনে কি হচ্ছে না, টান টান বারুদঠাসা এমন থ্রিলার আগে কোথায় যেন পড়েছেন?
হ্যাঁ,আজ যার কথা বলার জন্য আপনাদের সামনে এসেছি, আমি জানি, আমার মতো অজস্র অসংখ্য মানুষের কৈশোরের আকাশ জুড়ে তিনি বিচরণ করতেন। একটু হয়তো ভুল বললাম, তিনি হয়তো নন, তাঁর লেখা রোমাঞ্চকর গোয়েন্দাকাহিনীগুলোতেই আমাদের শৈশব-কৈশোর বুঁদ হয়ে থাকতো। আসলে লেখক হিসাবে তিনি সে সময় যেমন অন্তরালে ছিলেন,আজও সেই অন্তরালেই রয়ে গেছেন।
তিনি এক বিস্মৃত প্রতিভা ----বলা যেতে পারে, চিরবঞ্চিত এক ... এক জিনিয়াস ---মেঘে ঢাকা একতারা ...... কখনো যার নাম স্বপনকুমার কখনো শ্রীভৃগু, কখনো বা ডাক্তার এস এন পান্ডে।
স্বপনকুমার নামটা উচ্চারণ করলেই হুড়মুড়িয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি বা তার সহকারী রতনলাল। ১৯৫৩ সালে দীপক চ্যাটার্জি প্রথম পাঠকের দরবারে এসে হাজির হয়, স্বপনকুমারের লেখা সেই উপন্যাসের নাম ছিল “অদৃশ্য সংকেত”। সেইশুরু, পরবর্তী প্রায় তিন দশক জুড়ে স্বপনকুমারের গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির তেমন কোনো যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলনা।
“একহাতে উদ্যত পিস্তল, অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ! দীপক চ্যাটার্জি পাঁচতলা হইতে জলের পাইপ বাহিয়া বিদ্যুৎ গতিতে নিচে নামিয়ে গেল।“
গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির গল্পের এরকম জনপ্রিয় বর্ণনা প্রসঙ্গে সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার স্বীকার করেছেন যে “একবার শুরু করলে শেষ না করে থামা যেত না”।
যদিও শিক্ষিতবহু মানুষজ স্বপনকুমারের নায়ক গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির রহস্য রোমাঞ্চকর গল্প বা কাহিনীগুলিকে “পাল্পফিকশন” বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, তবু বইয়ের সংখ্যার নিরিখে এবং তাদের ধুন্ধুমার অকল্পনীয় সেই জনপ্রিয়তার নিরিখে স্বপনকুমার বা তার সৃষ্টিকে কখনো কেউই অস্বীকার করতে পারেনি। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা তোপসের যুগেও, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবুর যুগেও স্বপনকুমারের দীপক চ্যাটার্জি বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে আজও নিশ্চিতভাবেই গেঁথে আছে বলেই আমি বিশ্বাস করি। বলাবাহুল্য, শুধু দীপক চ্যাটার্জিই নয়, সেই থ্রীলারগুলির অ্যানটিহিরোরাও পাঠকদের হৃদয়ে আজও রাজ করে। ভাবুন একবার,কি বিচিত্র তাদের নাম ছিল। কারো নাম বাজপাখি, কারো নাম মিস্ট্রিম্যান, কারো বা নাম কালোনেকড়ে, কেউ বা ড্রাগন, আবার কারো নাম কালনাগিনী অথবা ব্ল্যাকপ্যান্থার --- এরকম আরো কত চরিত্র। বই প্রকাশিত হতো বিভিন্ন সিরিজের নাম দিয়ে। যেমন বাজপাখি সিরিজ, রহস্য কুহেলিকা সিরিজ, ক্রাইমওয়ার্ল্ড সিরিজ, কালরুদ্র সিরিজ, বিশ্বচক্র সিরিজ, কালনাগিনী সিরিজ ইত্যাদি প্রায় কুড়িটি সিরিজে বই প্রকাশিত হতো। শোনা যায়, বেশ কয়েকটি সিরিজের প্রতি সিরিজে একশর মতো বই থাকতো। ভাবুন একবার,কি বিপুল পরিমাণ লেখা স্বপনকুমার লিখেছিলেন।
তবে একথা ঠিকই যে স্বপনকুমারের লেখায় তেমন কোন সাহিত্যরস ছিল না, তার চরিত্রগুলোর মধ্যে কোন গভীরতা ছিল না। কিন্তু গল্পে অবাস্তব তথ্য এবং নানারকম ফাঁকফোকর থাকা সত্ত্বেও, বটতলার সেই৫০/৬০ পৃষ্ঠার সস্তা চটিবই হওয়া সত্ত্বেও, সেই মুচমুচে গল্প-কাহিনীগুলো ছিল পাঠকদের কাছে ভীষন ভীষণ ভাবে জনপ্রিয় --- আর এটাই ছিল স্বপনকুমারের অনন্যসাধারণ ক্যারিশমা।
আপনারা অনেকেই জানেন, স্বপনকুমার --- এই প্রতিভাধর লেখকের আসল নাম সমরেন্দ্র নাথ পান্ডে বা এস এন পান্ডে। জন্ম ১৯২৭সালের ২৬শেঅক্টোবর। আদি বাসভূমি বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা। বাবা ছিলেন ব্যারিস্টার। মাত্র ১৪ বছর বয়সে সমরেন্দ্র নাথ পান্ডে চলে আসেন কলকাতায়। আইনজীবী পরিবারের সন্তান হলেও, তার দুচোখে স্বপ্ন ছিল, তিনি ডাক্তার হবেন। ছাত্র হিসেবে যথেষ্ট মেধাবী ছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন আর জি কর মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে। এখানেই তার জীবনে ঘটলো নাটকীয় ঘটনা। তিনি যখন সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট, তখন বাড়ি থেকে খবর আসলো, আর্থিক অনটনে সংসার চলছে না, তুমি তোমার নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই জোগাড় কর।
ডাক্তারি ছাত্র সমরেন্দ্র নাথ পান্ডের জীবনের মোড় ঘুরে গেল। ছোটবেলা থেকেই বই পড়তেন, অল্প-স্বল্প লেখালিখির অভ্যাস ছিল। এবার তিনি বসে পড়লেন টাকা উপার্জনের জন্য গোয়েন্দা গল্প লিখতে। একই সময়ে জন্ম হলো দুজনের একদিকে যেমন লেখক স্বপনকুমার, অন্যদিকে তেমন গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি। পান্ডুলিপি নিয়ে সোজা হাজির বটতলার প্রেসে।
জেনারেল লাইব্রেরী প্রকাশনার কর্ণধার কৃষ্ণচন্দ্র গুপ্ত বইপাড়ায় যার নাম ছিল কেষ্টবাবু --- তিনি প্রথম ছাপতে শুরু করলেন স্বপনকুমারের বই। আর ছাপা মাত্রই হটকেকের মতো বাজারে বিক্রি হতে শুরু করলো স্বপনকুমারের বই।
শোনা যায়, আর্থিক অনটন দূর করার তাগিদে এবং অবশ্যই প্রকাশকদের প্রবল চাপে স্বপনকুমার শিয়ালদা স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে বিনামূল্যের ইলেকট্রিক আলো-হাওয়ায় তাঁর লেখা সম্পূর্ণ করতেন। পাবলিশাররা প্লাটফর্মে এসে তাঁর কাছে লেখা নিয়ে যেতেন এবং নতুন বইয়ের জন্য তাগিদ দিয়ে যেতেন। বেশির ভাগ সময়ে নুন আর কাঁচা টমেটো খেয়ে পেটের খিদে মেটাতেন স্বপনকুমার। তা এত কষ্টেরমধ্যে, লেখালেখির জগতে ডুবে থেকেও শেষ অবধি তিনি নাকি ডাক্তারি পাশ করেছিলেন। তার স্বজনরা বলেছেন,লেখালেখির জগতে বুঁদ হয়ে থাকতেন বলেই ডাক্তার হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা পাননি। তাছাড়া সেসময়, তার ঘাড়ে নাকি চেপে বসেছিল গরিবের ঘোড়া রোগ।অর্থাৎ ডাক্তারি শুরু করেছিলেন কিন্তু কারো কাছ থেকে পয়সা নিতেন না। এতে যা হবার তাই হল। বিনামূল্যে ডাক্তারদের কি আর পসার জমে ? তাই শেষ পর্যন্ত তাকে ডাক্তারি ছেড়ে লেখালেখির জগতে ফিরে আসতে হয়েছিল।
পেটের দায়ে তিনি এবার লিখতে শুরু করলেন জ্যোতিষীর বইও। আর বিস্ময়কর ভাবে তাতেও তিনি অকল্পনীয় ভাবে সফল হলেন। শ্রীভৃগু ছদ্মনামে তার জ্যোতিষী বিদ্যার চর্চার বইগুলোও বাজারে ছিল সুপার ডুপারহিট।
তা স্বপনকুমার থেকে শ্রীভৃগু হয়ে ওঠার ঘটনাটিও বেশ অবাক করার মতো। এক প্রকাশকের কাছে একদিন তিনি তার পাওনা টাকা আনতে গিয়েছিলেন।প্রকাশক তাকে বসিয়ে অন্য আরেকজনের হিসেব-নিকেশ করছেন দীর্ঘক্ষন ধরে। অধৈর্য হয়ে স্বপনকুমার বলেছিলেন,“আরে আমিও তো লিখি! আমাকে বসিয়ে রেখেছেন কেন?”
উত্তরে প্রকাশক নাকি বলেছিলেন,” আরে মশাইগোয়েন্দা গল্প তো সবাই লিখতে পারে! উনি জ্যোতিষের উপর বই লেখেন। অনেক টাকার ব্যবসা দেন, আগে ওকে ছাড়তে হবে।
স্বপনকুমার সেইদিনই প্রকাশকের দপ্তরে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন,জ্যোতিষশাস্ত্র শিখে বই লিখে তিনি একদিন দেখিয়ে দেবেন। শুরু হলো রাত জেগে, না খেয়েদেয়ে অমানুষিক এক পরিশ্রম--- জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা। লিখলেন বই ।আর তা এতটাই বাজারে জনপ্রিয় হলো যে একসময় একাধিক মানুষ বাজারে নিজেদেরকে শ্রীভৃগু বলে পরিচয় দিতে শুরু করলেন, প্রত্যেকেই দাবি করতেন, সে-ই নাকি আদি এবং অকৃত্রিম শ্রীভৃগু। আসলে স্বপনকুমারের গোটা জীবনটাই ছিল খিদের সঙ্গে লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে টাকার জন্য তিনি শুধুমাত্র রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পকাহিনী এবং জ্যোতিষী বিদ্যার বই লিখেই থেমেরইলেন না। লিখলেন প্রচুর ডাক্তারি বইপত্র। তাঁর লেখা “প্রাকটিস অফ মেডিসিন”, “টেক্সটবুক অফ প্যাথলজি”, “টেক্সটবুক অফ এ্যানাটমী” ---সে সময়ের বিখ্যাত সব বই---- বাজারে আজও তার বিক্রি প্রচুর। ডাক্তার এস এন পান্ডের ছদ্মনামে লেখা কোকশাস্ত্র আজও বাজারে কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও, শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে, তিনি লিখেছিলেন নানা বিষয়ে অসংখ্য বই ---- মোটর গাড়ির ড্রাইভিংর বই, ট্রানজিস্টার টেলিফোন টেলিভিশন মেরামতির বই, হাঁস মুরগি প্রতিপালন কিভাবে করতে হবে, গরু-ছাগল প্রতিপালন কিভাবে করতে হবে, টোটকা-আয়ুর্বেদের বই , সবজিচাষের বই, এমন কি... এমন কি ভারতীয় কামশাস্ত্রের বই! সত্যি কথা হলো, এটাই যে, বাংলা সাহিত্যের এত বিষয়বৈচিত্র্যনিয়ে --- সবকটি বিষয়ে বেস্টসেলার লেখার যোগ্যতা আর কোন সাহিত্যিকের আছে বলে আজ পর্যন্ত জানা নেই।
তবু অতন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে এটাই, জীবিত অবস্থায় তিনি যথাযথ সম্মান , অর্থ --- কোন কিছুই পাননি। প্রকাশকরা বারবার প্রতারণা করেছেন। প্রকাশকদের কাছ থেকে উপযুক্ত রয়েলিটি কখনো তিনি পাননি। অন্যদিকে,পাঠককুল! ... তারা তাঁর বই পড়ে অসাধারণ আনন্দ উপভোগ করেছেন, কিন্তু তাঁকে বিন্দুমাত্র মনে রাখেনি।
তবু... তবু ... এপার বাংলা, ওপার বাংলার বেশ কিছু মানুষ আজও স্বপন কুমারকে মনে রেখেছেন। কাদের উদ্যোগে কখনো দেব সাহিত্য কুটির, কখনো বা লালমাটি প্রকাশনী সংস্থা, বা আরো অনেক সংস্থা এই সময় দাঁড়িয়ে স্বপন কুমারের গোয়েন্দা কাহিনী সমগ্র প্রকাশ করেছেন, প্রকাশ করে চলেছেন ..... নতুন আঙ্গিকে, নতুন বইয়ের মলাটে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একদিন টিভি অথবা রুপালি পর্দায় স্বপনকুমারের গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জিকে আমরা নিশ্চিত দেখতে পাবো।
ভাগ্যবিরম্বিত এই অসাধারণ লেখক সমরেন্দ্র নাথ পান্ডে তথা শ্রীস্বপনকুমার 2001 সালের 15 ই নভেম্বর শ্যামনগরেরবাড়িতে অসহায় অবস্থায় , সবার অন্তরালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
26 শে অক্টোবর তার জন্মদিন আমার এই ভিডিও তার প্রতি আমার সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য।
....................................................................................
(প্রতিবেদনটি ভিডিওতে দেখার জন্য এই বাক্যে ক্লিক করুন)
তথ্যসূত্র:
১) দীপক রতন এবং স্বপনকুমার by শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় (আনন্দবাজার পত্রিকা)
২) জ্যোতিষী স্বপনকুমার(শ্রীভৃগু) এমবিবিএস by নিবেদিতা দাঁ (এইসময়পত্রিকা)
৩)স্বপনকুমার-শ্রীভৃগু-ডাক্তার এস এন পান্ডে---- এক বিস্মৃত প্রতিভার তিন নাম by ডা. তিলক পুরকায়স্থ (কৌলাল)
৪) বিস্মৃত গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি by নাজমুল হাসান দারাশিকো (দেশরূপান্তর)
৫) গোয়েন্দা কাহিনী, জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞান ----বিভিন্ন নামে বই লিখেছেন এই বাঙালি by প্রহরডেস্ক
৬) সমরেন্দ্র নাথ পান্ডে by উইকিপিডিয়া
হ্যাঁ,আজ যার কথা বলার জন্য আপনাদের সামনে এসেছি, আমি জানি, আমার মতো অজস্র অসংখ্য মানুষের কৈশোরের আকাশ জুড়ে তিনি বিচরণ করতেন। একটু হয়তো ভুল বললাম, তিনি হয়তো নন, তাঁর লেখা রোমাঞ্চকর গোয়েন্দাকাহিনীগুলোতেই আমাদের শৈশব-কৈশোর বুঁদ হয়ে থাকতো। আসলে লেখক হিসাবে তিনি সে সময় যেমন অন্তরালে ছিলেন,আজও সেই অন্তরালেই রয়ে গেছেন।
তিনি এক বিস্মৃত প্রতিভা ----বলা যেতে পারে, চিরবঞ্চিত এক ... এক জিনিয়াস ---মেঘে ঢাকা একতারা ...... কখনো যার নাম স্বপনকুমার কখনো শ্রীভৃগু, কখনো বা ডাক্তার এস এন পান্ডে।
স্বপনকুমার নামটা উচ্চারণ করলেই হুড়মুড়িয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি বা তার সহকারী রতনলাল। ১৯৫৩ সালে দীপক চ্যাটার্জি প্রথম পাঠকের দরবারে এসে হাজির হয়, স্বপনকুমারের লেখা সেই উপন্যাসের নাম ছিল “অদৃশ্য সংকেত”। সেইশুরু, পরবর্তী প্রায় তিন দশক জুড়ে স্বপনকুমারের গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির তেমন কোনো যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলনা।
“একহাতে উদ্যত পিস্তল, অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ! দীপক চ্যাটার্জি পাঁচতলা হইতে জলের পাইপ বাহিয়া বিদ্যুৎ গতিতে নিচে নামিয়ে গেল।“
গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির গল্পের এরকম জনপ্রিয় বর্ণনা প্রসঙ্গে সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার স্বীকার করেছেন যে “একবার শুরু করলে শেষ না করে থামা যেত না”।
যদিও শিক্ষিতবহু মানুষজ স্বপনকুমারের নায়ক গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির রহস্য রোমাঞ্চকর গল্প বা কাহিনীগুলিকে “পাল্পফিকশন” বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, তবু বইয়ের সংখ্যার নিরিখে এবং তাদের ধুন্ধুমার অকল্পনীয় সেই জনপ্রিয়তার নিরিখে স্বপনকুমার বা তার সৃষ্টিকে কখনো কেউই অস্বীকার করতে পারেনি। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা তোপসের যুগেও, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবুর যুগেও স্বপনকুমারের দীপক চ্যাটার্জি বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে আজও নিশ্চিতভাবেই গেঁথে আছে বলেই আমি বিশ্বাস করি। বলাবাহুল্য, শুধু দীপক চ্যাটার্জিই নয়, সেই থ্রীলারগুলির অ্যানটিহিরোরাও পাঠকদের হৃদয়ে আজও রাজ করে। ভাবুন একবার,কি বিচিত্র তাদের নাম ছিল। কারো নাম বাজপাখি, কারো নাম মিস্ট্রিম্যান, কারো বা নাম কালোনেকড়ে, কেউ বা ড্রাগন, আবার কারো নাম কালনাগিনী অথবা ব্ল্যাকপ্যান্থার --- এরকম আরো কত চরিত্র। বই প্রকাশিত হতো বিভিন্ন সিরিজের নাম দিয়ে। যেমন বাজপাখি সিরিজ, রহস্য কুহেলিকা সিরিজ, ক্রাইমওয়ার্ল্ড সিরিজ, কালরুদ্র সিরিজ, বিশ্বচক্র সিরিজ, কালনাগিনী সিরিজ ইত্যাদি প্রায় কুড়িটি সিরিজে বই প্রকাশিত হতো। শোনা যায়, বেশ কয়েকটি সিরিজের প্রতি সিরিজে একশর মতো বই থাকতো। ভাবুন একবার,কি বিপুল পরিমাণ লেখা স্বপনকুমার লিখেছিলেন।
তবে একথা ঠিকই যে স্বপনকুমারের লেখায় তেমন কোন সাহিত্যরস ছিল না, তার চরিত্রগুলোর মধ্যে কোন গভীরতা ছিল না। কিন্তু গল্পে অবাস্তব তথ্য এবং নানারকম ফাঁকফোকর থাকা সত্ত্বেও, বটতলার সেই৫০/৬০ পৃষ্ঠার সস্তা চটিবই হওয়া সত্ত্বেও, সেই মুচমুচে গল্প-কাহিনীগুলো ছিল পাঠকদের কাছে ভীষন ভীষণ ভাবে জনপ্রিয় --- আর এটাই ছিল স্বপনকুমারের অনন্যসাধারণ ক্যারিশমা।
আপনারা অনেকেই জানেন, স্বপনকুমার --- এই প্রতিভাধর লেখকের আসল নাম সমরেন্দ্র নাথ পান্ডে বা এস এন পান্ডে। জন্ম ১৯২৭সালের ২৬শেঅক্টোবর। আদি বাসভূমি বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা। বাবা ছিলেন ব্যারিস্টার। মাত্র ১৪ বছর বয়সে সমরেন্দ্র নাথ পান্ডে চলে আসেন কলকাতায়। আইনজীবী পরিবারের সন্তান হলেও, তার দুচোখে স্বপ্ন ছিল, তিনি ডাক্তার হবেন। ছাত্র হিসেবে যথেষ্ট মেধাবী ছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন আর জি কর মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে। এখানেই তার জীবনে ঘটলো নাটকীয় ঘটনা। তিনি যখন সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট, তখন বাড়ি থেকে খবর আসলো, আর্থিক অনটনে সংসার চলছে না, তুমি তোমার নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই জোগাড় কর।
ডাক্তারি ছাত্র সমরেন্দ্র নাথ পান্ডের জীবনের মোড় ঘুরে গেল। ছোটবেলা থেকেই বই পড়তেন, অল্প-স্বল্প লেখালিখির অভ্যাস ছিল। এবার তিনি বসে পড়লেন টাকা উপার্জনের জন্য গোয়েন্দা গল্প লিখতে। একই সময়ে জন্ম হলো দুজনের একদিকে যেমন লেখক স্বপনকুমার, অন্যদিকে তেমন গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি। পান্ডুলিপি নিয়ে সোজা হাজির বটতলার প্রেসে।
জেনারেল লাইব্রেরী প্রকাশনার কর্ণধার কৃষ্ণচন্দ্র গুপ্ত বইপাড়ায় যার নাম ছিল কেষ্টবাবু --- তিনি প্রথম ছাপতে শুরু করলেন স্বপনকুমারের বই। আর ছাপা মাত্রই হটকেকের মতো বাজারে বিক্রি হতে শুরু করলো স্বপনকুমারের বই।
শোনা যায়, আর্থিক অনটন দূর করার তাগিদে এবং অবশ্যই প্রকাশকদের প্রবল চাপে স্বপনকুমার শিয়ালদা স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে বিনামূল্যের ইলেকট্রিক আলো-হাওয়ায় তাঁর লেখা সম্পূর্ণ করতেন। পাবলিশাররা প্লাটফর্মে এসে তাঁর কাছে লেখা নিয়ে যেতেন এবং নতুন বইয়ের জন্য তাগিদ দিয়ে যেতেন। বেশির ভাগ সময়ে নুন আর কাঁচা টমেটো খেয়ে পেটের খিদে মেটাতেন স্বপনকুমার। তা এত কষ্টেরমধ্যে, লেখালেখির জগতে ডুবে থেকেও শেষ অবধি তিনি নাকি ডাক্তারি পাশ করেছিলেন। তার স্বজনরা বলেছেন,লেখালেখির জগতে বুঁদ হয়ে থাকতেন বলেই ডাক্তার হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা পাননি। তাছাড়া সেসময়, তার ঘাড়ে নাকি চেপে বসেছিল গরিবের ঘোড়া রোগ।অর্থাৎ ডাক্তারি শুরু করেছিলেন কিন্তু কারো কাছ থেকে পয়সা নিতেন না। এতে যা হবার তাই হল। বিনামূল্যে ডাক্তারদের কি আর পসার জমে ? তাই শেষ পর্যন্ত তাকে ডাক্তারি ছেড়ে লেখালেখির জগতে ফিরে আসতে হয়েছিল।
পেটের দায়ে তিনি এবার লিখতে শুরু করলেন জ্যোতিষীর বইও। আর বিস্ময়কর ভাবে তাতেও তিনি অকল্পনীয় ভাবে সফল হলেন। শ্রীভৃগু ছদ্মনামে তার জ্যোতিষী বিদ্যার চর্চার বইগুলোও বাজারে ছিল সুপার ডুপারহিট।
তা স্বপনকুমার থেকে শ্রীভৃগু হয়ে ওঠার ঘটনাটিও বেশ অবাক করার মতো। এক প্রকাশকের কাছে একদিন তিনি তার পাওনা টাকা আনতে গিয়েছিলেন।প্রকাশক তাকে বসিয়ে অন্য আরেকজনের হিসেব-নিকেশ করছেন দীর্ঘক্ষন ধরে। অধৈর্য হয়ে স্বপনকুমার বলেছিলেন,“আরে আমিও তো লিখি! আমাকে বসিয়ে রেখেছেন কেন?”
উত্তরে প্রকাশক নাকি বলেছিলেন,” আরে মশাইগোয়েন্দা গল্প তো সবাই লিখতে পারে! উনি জ্যোতিষের উপর বই লেখেন। অনেক টাকার ব্যবসা দেন, আগে ওকে ছাড়তে হবে।
স্বপনকুমার সেইদিনই প্রকাশকের দপ্তরে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন,জ্যোতিষশাস্ত্র শিখে বই লিখে তিনি একদিন দেখিয়ে দেবেন। শুরু হলো রাত জেগে, না খেয়েদেয়ে অমানুষিক এক পরিশ্রম--- জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা। লিখলেন বই ।আর তা এতটাই বাজারে জনপ্রিয় হলো যে একসময় একাধিক মানুষ বাজারে নিজেদেরকে শ্রীভৃগু বলে পরিচয় দিতে শুরু করলেন, প্রত্যেকেই দাবি করতেন, সে-ই নাকি আদি এবং অকৃত্রিম শ্রীভৃগু। আসলে স্বপনকুমারের গোটা জীবনটাই ছিল খিদের সঙ্গে লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে টাকার জন্য তিনি শুধুমাত্র রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পকাহিনী এবং জ্যোতিষী বিদ্যার বই লিখেই থেমেরইলেন না। লিখলেন প্রচুর ডাক্তারি বইপত্র। তাঁর লেখা “প্রাকটিস অফ মেডিসিন”, “টেক্সটবুক অফ প্যাথলজি”, “টেক্সটবুক অফ এ্যানাটমী” ---সে সময়ের বিখ্যাত সব বই---- বাজারে আজও তার বিক্রি প্রচুর। ডাক্তার এস এন পান্ডের ছদ্মনামে লেখা কোকশাস্ত্র আজও বাজারে কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও, শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে, তিনি লিখেছিলেন নানা বিষয়ে অসংখ্য বই ---- মোটর গাড়ির ড্রাইভিংর বই, ট্রানজিস্টার টেলিফোন টেলিভিশন মেরামতির বই, হাঁস মুরগি প্রতিপালন কিভাবে করতে হবে, গরু-ছাগল প্রতিপালন কিভাবে করতে হবে, টোটকা-আয়ুর্বেদের বই , সবজিচাষের বই, এমন কি... এমন কি ভারতীয় কামশাস্ত্রের বই! সত্যি কথা হলো, এটাই যে, বাংলা সাহিত্যের এত বিষয়বৈচিত্র্যনিয়ে --- সবকটি বিষয়ে বেস্টসেলার লেখার যোগ্যতা আর কোন সাহিত্যিকের আছে বলে আজ পর্যন্ত জানা নেই।
তবু অতন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে এটাই, জীবিত অবস্থায় তিনি যথাযথ সম্মান , অর্থ --- কোন কিছুই পাননি। প্রকাশকরা বারবার প্রতারণা করেছেন। প্রকাশকদের কাছ থেকে উপযুক্ত রয়েলিটি কখনো তিনি পাননি। অন্যদিকে,পাঠককুল! ... তারা তাঁর বই পড়ে অসাধারণ আনন্দ উপভোগ করেছেন, কিন্তু তাঁকে বিন্দুমাত্র মনে রাখেনি।
তবু... তবু ... এপার বাংলা, ওপার বাংলার বেশ কিছু মানুষ আজও স্বপন কুমারকে মনে রেখেছেন। কাদের উদ্যোগে কখনো দেব সাহিত্য কুটির, কখনো বা লালমাটি প্রকাশনী সংস্থা, বা আরো অনেক সংস্থা এই সময় দাঁড়িয়ে স্বপন কুমারের গোয়েন্দা কাহিনী সমগ্র প্রকাশ করেছেন, প্রকাশ করে চলেছেন ..... নতুন আঙ্গিকে, নতুন বইয়ের মলাটে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একদিন টিভি অথবা রুপালি পর্দায় স্বপনকুমারের গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জিকে আমরা নিশ্চিত দেখতে পাবো।
ভাগ্যবিরম্বিত এই অসাধারণ লেখক সমরেন্দ্র নাথ পান্ডে তথা শ্রীস্বপনকুমার 2001 সালের 15 ই নভেম্বর শ্যামনগরেরবাড়িতে অসহায় অবস্থায় , সবার অন্তরালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
26 শে অক্টোবর তার জন্মদিন আমার এই ভিডিও তার প্রতি আমার সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য।
....................................................................................
(প্রতিবেদনটি ভিডিওতে দেখার জন্য এই বাক্যে ক্লিক করুন)
তথ্যসূত্র:
১) দীপক রতন এবং স্বপনকুমার by শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় (আনন্দবাজার পত্রিকা)
২) জ্যোতিষী স্বপনকুমার(শ্রীভৃগু) এমবিবিএস by নিবেদিতা দাঁ (এইসময়পত্রিকা)
৩)স্বপনকুমার-শ্রীভৃগু-ডাক্তার এস এন পান্ডে---- এক বিস্মৃত প্রতিভার তিন নাম by ডা. তিলক পুরকায়স্থ (কৌলাল)
৪) বিস্মৃত গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি by নাজমুল হাসান দারাশিকো (দেশরূপান্তর)
৫) গোয়েন্দা কাহিনী, জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞান ----বিভিন্ন নামে বই লিখেছেন এই বাঙালি by প্রহরডেস্ক
৬) সমরেন্দ্র নাথ পান্ডে by উইকিপিডিয়া





Comments
Post a Comment